Published : 23 Dec 2023, 09:43 PM
নবাবগঞ্জের পূর্ব চুড়াইন স্কুল মাঠে সালমান এফ রহমানের জনসভা। সকাল থেকেই সেখানে নেতাকর্মীদের ভিড়, রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও।
বেলা ১১টার পর নৌকার প্রার্থী সেখানে উপস্থিত হতেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তাকে স্বাগত জানান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সালমান গাড়ি বহর থেকে নেমে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে এগিয়ে চললেন মঞ্চের দিকে।
এখানে মতবিনিময় শেষে তিনি আরও কয়েকটি স্কুলের মাঠে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা করেন। এসব সভার ফাঁকে ফাঁকে জনগংযোগও করেন প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা।
এদিন তার প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান সালমা ইসলামের প্রচারেও উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি ছিল না। তিনিও মতবিনিময় সভা করেছেন বিভিন্ন স্থানে। লাঙ্গলের হয়ে ভোট চেয়েছেন স্থানীয়দের কাছে।
বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের এই নির্বাচনে ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলা মিলিয়ে ঢাকা-১ আসনটি ভিন্ন আমেজ নিয়ে এসেছে। সেখানে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে চাইছে না। যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে ২৬ আসনে এ দুই দলের সমঝোতা হয়েছে।
আসনটিতে এ দুইজন ছাড়াও তৃণমূল বিএনপির মুফিদ খান সোনালী আঁশ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির শামসুজ্জামান চৌধুরী একতারা, গণফ্রন্টের শেখ মো. আলী মাছ, ওয়ার্কার্স পার্টির মো. করম আলী হাতুড়ি এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আ. হাকিম আম প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। তবে তারা কেউ আলোচনায় নেই।
শনিবার নির্বাচনি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জনসমাগমস্থল ও সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড় সালমান ও সালমার পোস্টারে ছেয়ে আছে। নির্বাচনি ক্যাম্পও আছে বহু, গানবাজনার মাধ্যমে ঘুরে ঘুরে চাওয়া হচ্ছে ভোট।
সালমানের প্রচারে জমজমাট ভাব
নবাবগঞ্জ উপজেলার চৃড়াইন, আলগা এবং গালিমপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুর্ব চুড়াইন তারিনি বামা উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলগা ইউনিয়নের চান্দেরটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মহাকবি কায়কোবাদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং গালিমপুর ইউনিয়নের গালিমপুর রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্রভিত্তিক শনিবার মতবিনিময় সভা করেন সালমান রহমান। প্রতিটিতেই নেতাকর্মীরা মিছিল করে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সভাস্থলে আসেন।
সকাল ১০টার পর চুড়াইন ইউনিয়নের গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে কেন্দ্রভিত্তিক প্রথম মতবিনিময় সভা করেন নৌকার প্রার্থী।
তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদ ও গত পাঁচ বছর ধরে তার উদ্যোগে দোহার-নবাবগঞ্জে করা উন্নয়নকাজের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। বলেন, উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ভোট দিতে হবে নৌকায়।
তিনি বলেন, “বিএনপি নির্বাচন বানচাল করার নানা ধরনের চেষ্টা করছে। নির্বাচন নিয়ে তারা এতদিন যেসব কথা বলেছে সেগুলো যে ভুয়া কথা তা প্রমাণ হয়ে গেছে। এই নির্বাচন যে সবার অংশগ্রহণে জমজমাট সেটি ৭ জানুয়ারি প্রমাণ করে দিতে হবে।
“আমাদের সবার উপর একটা বড় দায়িত্ব চলে এসেছে। প্রমাণ করে দিতে হবে বাংলাদেশে নির্বাচনে মানুষ অংশ্রগহণ করে। সেদিন আপনারা নিজে, আপনাদের পরিবারের সবাইকে, আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে।”
সালমান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দোহার-নবাবগঞ্জে এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়িত হয়েছে, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে রাস্তা হয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক হয়েছে। কেরাণীগঞ্জ হয়ে হয়ে দোহার পর্যন্ত সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছে।
ইতিহাস গড়তে চান সালমা
একই দিন নবাবগঞ্জের আগলা ইউনিয়নের মাঝপাড়ায় লাঙ্গল মার্কার সমর্থনে করা নির্বাচনি ক্যাম্প উদ্বোধনের মাধ্যমে দিনের প্রচার শুরু করেন সালমা ইসলাম। বেলা ১১টার দিকে এই আয়োজনে ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি।
এরপর আগলা বাজার, টিকরপুর, কোমরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটারদের কাছে ভোট চান লাঙ্গলের প্রার্থী। দুপুরে গালিমপুর ইউনিয়নের নোয়াদ্দা এলাকায় উঠান বৈঠক করেন তিনি।
নোয়াদ্দার সেই উঠান বৈঠকে সালমা বলেন, প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছেন। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জিততে পারেননি। গত পাঁচ বছর এলাকায় তেমন উন্নয়নও হয়নি।
গত নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি অভিযোগ করে জাতীয় পার্টির এই প্রার্থী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তিনি অবাধ, সুষ্ঠু, নির্বাচন দিয়ে জাতিকে দেখিয়ে দেবেন। আমরা যদি লাঙ্গল মার্কা দিয়ে নৌকাকে হারাতে পারি, তাহলে সেটা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে।”
বিকালে কলাকোপা ইউনিয়নের বাগমারা বাজারে নির্বাচনি সভার মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শেষ করেন সালমা।
ভোটারদের ভাবনা
১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বর্তমান সংসদীয় আসনটি ছিল ঢাকা-১ ও ঢাকা-২ নামে দুটি আসন। চারটি নির্বাচনেই দুটি আসনে জেতে বিএনপি।
২০০৮ সালে সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন এবং বিএনপির প্রার্থী আবদুল মান্নান হেরে যাওয়ার পর রাজনীতিতে তৈরি হয় নতুন সমীকরণ। তবে এলাকায় বিএনপির বিপুল পরিমাণ সমর্থক যে রয়ে গেছে, সেই বিষয়টি বোঝা যায় এলাকায় গেলেই। বিএনপি সমর্থকরা ৭ জানুয়ারি কেন্দ্রে যাবে কি যাবে না, গেলে কার পক্ষে থাকবে, সেটিও ভোটের ফলাফল নির্ধারণে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
কোমরগঞ্জ এলাকার ভোটার সাজ্জাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু হইলে আর বিএনপির সমর্থকরা ভোট দিলে ফলাফল যে কোনো দিকে যাইতে পারে।
“বিএনপির লোকজন নৌকায় ভোট দিব না। তারা ভোট দিতে পারলে সালমারেই দিব। তারা যদি কেন্দ্রে আসে তাহলে ভালো ফাইট হবে।”
চুড়াইন বাজারে কথা হয় জাতীয় পার্টির সমর্থক হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জাতীয় পার্টির জেতার ভালো সম্ভাবনা আছে।
“সালমা রহমান এমপি থাকার সময় ভালো কাজ করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় তাদের কিছু ভোটও লাঙ্গল পাবে। যদি ভোট সুষ্ঠু হয় তাহলে সালমা ইসলাম জিতবেন।”
তবে আগলা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হরিপদ দাস মনে করেন, আসনটিতে আওয়ামী লীগের ভোট বেশি।
তিনি বলেন, “আগে বিএনপির ভোট আছিল, কিন্তু হেগো তো নেতাই নাই, মইরা গেছেগা। এখন নেতা নাই। মানুষ নৌকায়ই সিল মারব।”
২০০১ সালের পরের জয়-পরাজয়
২০০১ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে প্রথমবার লড়েন সালমান এফ রহমান। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে হেরে যান বিএনপির নাজমুল হুদার কাছে।
সে সময় আসনটি ছিল কেবল দোহার উপজেলা নিয়ে। তিনি প্রার্থী হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল দুর্বল।
২০০৮ সালে দোহারের পাশাপাশি নবাবগঞ্জ উপজেলা নিয়ে হয় একটি আসন। নৌকার মনোনয়ন পান আবদুল মান্নান খান। ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবারের মতো সেখানে জয় পায় আওয়ামী লীগ।
বিএনপির বর্জনে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে সেখানে আওয়ামী লীগের ছাড়ে সংসদ সদস্য হন সালমা ইসলাম।
তবে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মহাজোট থেকে মনোনয়ন পান সালমান। দলের প্রতীক না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন সালমা।
ভোটের ফল ছিল সালমানের পক্ষে। তিনি নৌকা নিয়ে জেতেন ৩ লাখ ২ হাজার ৯৯৩ ভোট পেয়ে, সালমার মোটরগাড়িতে পড়ে ৩৭ হাজার ৭৬৩ ভোট।
বিএনপির বর্জনে এবারের ভোটে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে জোট হয়নি। তবে দুই দলের মধ্যে হয়েছে আসন সমঝোতা। সালমা চাইছিলেন তাকে আসনটি ছেড়ে দিক আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেটি হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমানকেই সেখানে প্রার্থী রাখে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন সালমাও। এবার লাঙ্গল নিয়ে মোকাবিলায় প্রস্তুত তিনি।
সালমা যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের স্ত্রী। এলাকায় তারও ব্যাপক পরিচিতি আছে।
ভোটারের হিসাবনিকাশ
আসনটিতে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজারের বেশি।
এই আসন থেকে ১৯৮৬ সালে ঢাকা-১ আসনে জেতেন আওয়ামী লীগের মোস্তাফা মহসীন মন্টু। ১৯৮৮ সাল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বর্জনের ভোটে জেতেন জাতীয় পার্টির সাইফুর রহমান।
এরপর ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে জেতেন বিএনপির নাজমুল হুদা।
নবাবগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত ঢাকা-২ আসনে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জেতেন জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা।
এরপর ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চারবার জেতেন বিএনপির আবদুল মান্নান।
২০০৮ সালে দুটি এলাকা একটি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের পর আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান খান জয় পান।