Published : 21 Aug 2023, 08:43 PM
রাতারাতি ধনী হওয়ার ফাঁদে পা দিয়ে এমটিএফই নামে একটি বিদেশি অ্যাপে বিনিয়োগ করে কুমিল্লার শত শত মানুষ এখন হাহাকার করছেন।
প্রতারিত হওয়ার পর তারা না পাচ্ছেন তথাকথিত টিম লিডারদের দেখা; না পারছেন এ ব্যাপারে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে।
ঠিক কত মানুষ এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই কারও কাছে। তবে বোঝা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই যুবক। গোটা জেলাতেই বিছানো ছিল এই চক্রের জাল।
এমটিএফই অ্যাপে যারা বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছেন সেসব ‘টিম লিডারদের’ প্রায় সবাই মুরাদপুর উপজেলার বাসিন্দা। ধারণা করা হচ্ছে, ওই উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রতারিত হয়েছেন।
যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছেন, তারা এমন বিষয় শুনেছেন। কিন্তু কেউ তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি।
অপরদিকে ‘টিম লিডাররা’ বলছেন, ব্যবসায় লাভ-লোকসান আছেই; যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা ‘বুঝেশুনেই’ বিনিয়োগ করেছেন।
প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা জানান, মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ-এমটিএফই হচ্ছে দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলে ব্যবসা করত প্রতিষ্ঠানটি। এখানে বিনিয়োগকারীদের একটি অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়।
বিনিয়োগকারী যার মাধ্যমে বিনিয়োগ করবেন তিনিও এর কমিশন পাবেন। কারও অধীনে ১০০ বিনিয়োগকারী থাকলে তিনি ‘সিইও’ হিসেবে গণ্য হবেন। মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (যেমন বিটকয়েন) বিনিয়োগ করতে হয়। যদিও ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।
বিনিয়োগকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিম লিডাররা বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে শুরুতে গ্রাহকদের তিন হাজার টাকায় এমটিএফই প্ল্যাটফর্মে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দিত। প্রতিটি অ্যাকাউন্টে ‘রেফার’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে টিম লিডারের হিসাব বা আইডি নম্বর। পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগকারীরা এই অ্যাপে ডলার জমা করতেন।
বলা হত, এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা করে লাভ পাওয়া যাবে। এই ফাঁদে পড়েই অনেকে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সম্প্রতি বিনিয়োগকারীরা টাকা তুলতে পারছিলেন না, তখন বলা হয় সফটওয়্যার আপডেটের কথা। হঠাৎ করেই বিনিয়োগকারীদের অ্যাপের অ্যাকাউন্টে জমা থাকা ডলারের বিপরীতে সমপরিমাণ দেনা দেখাতে থাকে। তারা নিজেদের অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পারছিলেন না। পরে অ্যাপটি উধাও হয়ে যায়।
‘৫ লাখ বিনিয়োগ করে মাস না যেতেই আমি নিঃস্ব’
কুমিল্লা নগরীর টমছম ব্রিজ এলাকার বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমান এই অ্যাপ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তাকেসহ কয়েকজনকে এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন কথিত টিম লিডার মুরাদনগরের আহম্মেদ বিন শামীম।
তার কথা শুনেই মিজান কুমিল্লায় তাদের একটি সেমিনারে অংশ নেন। সেখানে বলা হয়, লাখ টাকায় প্রতিদিন ২ হাজার টাকা লাভ আসবে, লোকসানের আশঙ্কা নেই। সেখান থেকেই বিনিয়োগে উদ্বুব্ধ হন তিনি।
মিজান বলেন, “এই অ্যাপে গত মাসে বিনিয়োগ করেছি ৫ লাখ টাকা। কিন্তু মাস না যেতেই আমার ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। আমি এখন নিঃস্ব। টিম লিডারের দেখাও পাচ্ছি না।”
মিজানের মত তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখন পরিবারের চাপের মধ্যে পড়েছেন আবুল খায়ের নামে আরেক ভুক্তভোগী।
তিনি বলছিলেন, “চলতি বছরের শুরুতে এই অ্যাপের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রথমে কিছু টাকা লাভ হয়েছিল। তখন আমরা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করতাম। টিমলিডার মুরাদনগরের গোলাম মাওলা টিটু হোয়টসঅ্যাপ গ্রুপে পরামর্শ দেন অটো ট্রেড করার জন্য।
“এ পদ্ধতিতে ট্রেড করে কয়েক দিনের মধ্যে আমার ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। এখন পরিবারের চাপে আছি। টাকার কোনো হিসাব দিতে পারছি না।”
নগরীর চর্থা এলাকার বাসিন্দা মনির আহমেদ জানান, এই অ্যাপটি যুবসমাজের মধ্যে ঝড় তুলেছিল। টিমলিডার নামধারীরা কুমিল্লা নগরীসহ বিভিন্ন স্থানে মার্কেটে অফিস নিয়েও এই অ্যাপের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।
মনিরের ধারণা, যুবকদের ‘ডেসটিনির মত’ ফাঁদে ফেলেছে। তার এলাকার অন্তত ২০ জন যুবক প্রতারণায় পড়ে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা খুইয়েছেন।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লায় প্রথমে এই অ্যাপটি পরিচিত করান মুরাদনগরের ধামঘর গ্রামের আহম্মেদ বিন শামীম। পরে শামীম টিমলিডার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন একই উপজেলার গুঞ্জর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে গোলাম মাওলা টিটুকে।
পরে শামীম ও টিটু মিলে মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জ কলেজ সুপার মার্কেটে অফিস খুলে এই অ্যাপের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন।
ধামঘর গ্রামের বাসিন্দা মো. রমজান আলী বলেন, “আমাদেরকে এই অ্যাপের সঙ্গে পরিচয় করায় গ্রামের আহম্মেদ বিন শামীম। তখন তিনি বলেন, এখানে বিনিয়োগ করলে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা নেই। এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা লাভ থাকবে। তবে প্রতিমাসে একবার লোকসান হবে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা।
“তার কথামত এই অ্যাপে বিনিয়োগ করি কয়েক লাখ টাকা। কিন্তু মাস না যেতেই আমার ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। আমি এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। শামীমকেও এখন খুঁজে পাচ্ছি না।”
উপজেলার বাঙ্গরা এলাকার বাসিন্দা নাহিদ হাসান বলেন, তার প্রায় ৭ লাখ টাকা গেছে। পরিবারের লোকজন টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। টিমলিডারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
একই অবস্থায় সাইমন সরকারের। তিনি এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।
টিমলিডাররা যা বললেন
এ বিষয়ে কথা বলতে শনিবার অ্যাপটির টিম লিডার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর গ্রামের আহম্মেদ বিন শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
তখন তিনি বলেন, “আমরা কাউকে লাভের নিশ্চয়তা দিয়ে কিংবা লোভ দেখিয়ে এখানে বিনিয়োগে উৎসাহিত করিনি। আমরা অ্যাপ সম্পর্কে তাদের প্রশিক্ষিত করেছি। সবাই যার যার ইচ্ছামত এখানে বিনিয়োগ করেছে এবং লাভও পেয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমরা কুমিল্লা শহরে বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমেও বিনিয়োগকারীদের বুঝিয়েছি। এখন আমাদের কোনো দায়ভার নেই। সবাই বুঝেশুনে বিনিয়োগ করেছেন।”
আরেক টিম লিডার গোলাম মাওলা টিটু সাংবাদিকদের বলেন, “আমি তো আর এই অ্যাপের মালিক না। এই অ্যাপের মালিক একটি বিদেশি কোম্পানি। যারা এখানে ইনভেস্ট করেছেন, তারা বুঝেশুনেই করেছেন। সব ব্যবসায় লাভ-লোকসান রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সেটা আমরা আগেই বলেছি।”
পুলিশের ভাষ্য
মুরাদনগর থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, “এ রকম কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। যদি কেউ অভিযোগ করে, তাহলে তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ এবং নিষিদ্ধ বলে জানান কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আহমেদ সঞ্জুর মোর্শেদ।
তিনি বলেন, “অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে যুবকরা প্রতারিত হয়েছে, এ রকম কথা শুনলেও এখনও কোনো অভিযোগ পাইনি। যদি কেউ অভিযোগ করে, তাহলে খোঁজ-খবর নিয়ে তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”