Published : 27 Jul 2023, 03:13 PM
সোনালী আঁশ পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজবাড়ীর চাষিরা। জাগ দেওয়ার ব্যবস্থা না হওয়ায় পাট কাটছেন না তারা। এতে যেমন আমন আবাদ পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তেমনি হালকা বৃষ্টিতে ক্ষেতে পানি জমে যাওয়ায় পাট গাছের গোড়া পচে যাওয়া শুরু হয়েছে।
আবার পানির সঙ্কটে জাগ দিতে গিয়ে খরচ বাড়ছে, অল্প পানিতে জাগ দেওয়ায় রং ভালো হচ্ছে না। সব মিলিয়ে পাট চাষ করে বড় ক্ষতির শঙ্কায় মাথায় হাত দেওয়ার মত অবস্থায় রয়েছেন কৃষকরা।
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজবাড়ীতে এ বছর ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। তার মধ্যে এখন পর্যন্ত জেলায় ২০ শতাংশ পাট কাটা হয়েছে।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, কৃষকেরা ডোবা, নালা, পুকুর যে যেখানে পারছেন সেখানেই গাদাগাদি করে পাট জাগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেক কৃষক ভাড়া করা পুকুরে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি দিয়ে পাট জাগের ব্যবস্থা করছে। এতে করে কৃষকের খরচ বেড়ে যাচ্ছে অন্যদিকে অল্প পানিতে পাট জাগের কারণে পাটের রং খারাপ হওয়ায় বাজারে দাম কম পাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
অনেক কৃষক ভ্যানে করে বাড়তি শ্রমিক দিয়ে তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে নিয়ে হড়াই নদী, চন্দনা নদী বা পদ্মা নদীতে জাগ দিচ্ছেন। সেই পাট পচার পর একইভাবে বাড়িতে নিয়ে আসছেন, এতে তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
সদর উপজেলার চন্দনী ইউনিয়নের কৃষক কামাল শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাট নিয়ে আমরা চরম কষ্টের মধ্যে আচি। পাট এহন গলার কাটা হয়া রয়ছে। তিন পাখি ভূইতে (স্থানীয়ভাবে ২৫ শতাংশ জমিতে এক পাখি) পাট চাষ করছি। এ পর্যন্ত ২৮ হাজার খরচ হয়চে। এহনো ধুয়ার খরচ পরেই আচে।”
তিনি আরও বলেন, “পাট জাগ দিয়ার জাগা নাই। ভাবছিলাম জাগা ঠিক করে ভূইয়েতে (জমিতে) পাট কাটপো। তার আগেই কাটে ফেলতি হচ্চে। কয়দিন আগে বৃষ্টি হওয়ার পানি জমে আছে। এহন পাটের গুড়া পচে যাচ্ছে। তাই কাটে ফেলছি।
“প্রায় এক কিলোমিটার পথ হাঁটু পানির মদ্দি দিয়ে পরেত (শ্রমিক) দিয়ে পাট মাতায় করে টানে আনে রাস্তায় রাখতেছি। হেনতে ভ্যানে করে নিয়ে যাবো দুই কিলোমিটার দূরে নদীতি। এই তিন পাখি ভূইয়ের পাট কাটে জাগ দিতি যেনে আমার চার-পাচ জন পরেত লাগতো সেনে লাগতেছে ১৫-২০ জন।
“প্রতিজন পরেতের দিনি পাঁচশ টাকা ও তিন বেলা খাবার দিওয়া লাগে। নিজি কাম করতিছি সিটা বাদই দিলাম।
কিছুটা দূরে জমি থেকে পাট কাটছিলেন কৃষক ইউনুস আলী সরদার। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দুই পাখি জমিতে পাট বুনছি। ইনটোটাল আমার খরচ যাবে ৪০ হাজার টাকা। এখন পাটের যে অবস্থা তাতো দেখতেই পারছেন। এখন আমরা কি করবো কিছু বুঝতেছি না।
“পানি নাই পাট জাগের জন্য। কোনে জাগ দিবো সেটাই ভাবছি। আবার অল্প পানিতে পাট জাগ দিলে পাটের রং হবে না। তখন বাজারে দাম কম পাবো। বতর্মানে পাটের দাম যাচ্ছে দুই হাজার টাকা মণ। এই দাম হলে কৃষক বাঁচবে না।”
আরেক কৃষক নুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একদিকে পানি নাই, অন্যদিকে বৃষ্টিতি পাটের গুড়া পচে যাচ্চে। এক পাখিতে খরচ হয়চে দশ হাজার টাকা। মনে হয় না যে খরচের টাকা উটপি। ইবার লচ যাবি।”
“আবার অনেক কৃষক আচে জাগ দিওয়ার জাগা নাই, তাই পাট কাটতি পারতেছে না। পাট কাটতি না পারলি ধান লাগাতিই পারবি না।”
কালুখালী উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের কৃষক বীরেন দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাট ক্ষেত থেকে পাট কাটিচি। কিন্তু জাগ দিওয়ার জাগা পাই নাই। তাই নিজির জমিতি ১০ হাজার টাকা খরচ করে বেকু মেশিন দিয়ে পুকুর কাটচি। এহন শ্যালো মেশিনে পানি দিয়ে ভরে পাট জাগ দিচ্চি।”
তিনি আরও বলেন, “সাড়ে তিন পাখি জমিতে পাট বুনচিলাম। এ পর্যন্ত হাজার বিশেক টাকা খরচ হয়চে। আর কয়দিন পর পাট কাটা-ধুয়ার সময় পরেত পাওয়ায় কষ্ট হবি।
“একেক জন পরেতকে সাত থেকে আটশ’ টাকা দিতি হবে প্রতিদিন। এতে আরও ১৫ হাজার টাকা খরচ হবি। প্রতি পাখিতে গড়ে ছয় মণ পাট পালি ১৮ মণ পাট পাতি পারি। দুই হাজার টাকা পাটের মণ হলে ৩৬ হাজার টাকা পাবোনে। এতে তো লচ যাবিনি।”
পাশেই ছিলেন আরেক কৃষক আনোয়ার হোসেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের একটা পুকুর আছে। সেই পুকুর গভীর করতে ২০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। সেখানে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উঠিয়ে পাট জাগের ব্যবস্থা করছি।
কিন্তু এক লিটার ডিজেলের দাম ১১৫ টাকা। আমাদের মেশিন এক লিটার তেলে চলে আধা ঘণ্টা। একরাত পানি দিতে ২৫-৩০ লিটার তেলের প্রয়োজন হয়। তার দাম তিন হাজার টাকা। এই তিন হাজার টাকা তেলের পানি দিয়ে তিন হাজার টাকার পাট জাগ দেওয়া যাবে না।”
তিনি বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে কৃষকেরা আগামীতে পাট চাষ করবে না। সরকার থেকে যদি এই সময়টা কৃষকদের তেলের ভর্তুকি দিতো তাহলে কৃষকেরা একটু বাঁচতো।”
আরেক কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, “অল্প পানিতে পাট জাগের জন্নি পাটের কালার আসতেছে না। এই পাট ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকা মণ বিক্রি হবি।”
সরকার পাট জাগ দিতে বিভিন্ন সময় রিবন রেটিং পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য প্রচার চালালেও তাতে আগ্রহ দেখান না চাষিরা।
এ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বাগদুলী গ্রামের কৃষক মেহেদী হাসান বলেন, “রিবন রেটিং পদ্ধতিতে আমরা পাট পচাতে আগ্রহী না। এর কারণ হলো রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাটের রং কালচে হয়। ওই পাট বাজারে বিক্রি করতে গেলে দাম পাওয়া যায় না। এ জন্য আমাদের অঞ্চলে কেউ এই পদ্ধতিতে পাট পচায় না।”
এদিকে পাংশা উপজেলার মৌরাট ইউনিয়নের বাগদুলি বাজারের পাট ব্যবসায়ী সৌরভ সরদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাট এখনো পুরোদমে বাজারে উঠা শুরু করে নাই। বতর্মানে পাটের মান ভেদে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা মণ দাম।”
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ "বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজবাড়ীতে জলাশয়ে কৃষকদের পাট জাগ দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিএডিসির কিছু খাল রয়েছে সেখানে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছি।
এছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কিছু পুকুর আছে সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। আমরা মৌখিকভাবে তাদের অনুরোধ করেছি কোনো কৃষক পাট জাগ দিতে গেলে তারা যেন পুকুর ছেড়ে দেয়। এছাড়াও যে সব এলাকায় পানি নেই সেই এলাকার কৃষকদের নদীতে পাট জাগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আশা করছি পাট কাটা দেরি হলে আমন আবাদে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ ইতিমধ্যে আমনের বীজতলা রোপণের উপযোগী হয়ে গেছে। এরপরও যদি দেখি আমন আবাদ ব্যাহত হচ্ছে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।