Published : 25 Jun 2025, 01:30 PM
‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগে নরসুন্দর বাবা ও ছেলেকে গ্রেপ্তারের পর লালমনিরহাট সদর থানার ওসির একটি বক্তব্য ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এরই মধ্যে বক্তব্যটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
রোববার কিছু লোক লালমনিরহাট শহরের হানিফ পাগলার মোড়ে সেলুনে কর্মরত অবস্থায় পরেশ চন্দ্র শীল (৬৯) এবং তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে (৩৫) মহানবীকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে মারধর করে। তারা সেখানে হট্টগোল তৈরি করেন।
পরে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। তখন উত্তেজিত জনতা খবর পেয়ে থানা ঘেরাও করে। সেই পরিস্থিতিতে থানার ওসি নূরনবী জনতার উদ্দেশে কিছু কথা বলেন। সেই বক্তব্যই মঙ্গলবার থেকে ফেইসবুকে ঘুরছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বাবা ও ছেলেকে এভাবে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দের ঘটনাটিকে ‘মব সন্ত্রাস’ আখ্যায়িত করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তারা এ ঘটনায় উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে ‘মব সন্ত্রাসের’ সব ঘটনার বিচার দাবি করেছে।
ভুক্তভোগীদের পরিবার বলছে, চুল কাটার টাকা কম দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে’ এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। পরিবারটি নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার কথাও বলেছে।
এ ঘটনায় শহরের নামাটারী আল হেরা জামে মসজিদের ইমাম মো. আবদুল আজিজ বাদী হয়ে পরেশ চন্দ্র শীল ও বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে আসামি করে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক কার্যক্রম ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার দুপুর ২টার দিকে পরেশ ও ছেলে বিষ্ণু নিজেদের সেলুনে কাজ করছিলেন। তখন কিছু লোক এসে তাদের বিরুদ্ধে মহানবীকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তোলে ঘিরে ধরেন এবং হট্টগোল সৃষ্টি করেন। তারা কিছু ভাঙচুর করে। প্রথমে তারা পরেশ চন্দ্র শীলকে মারধর করেন। তাতে বাধা দিলে ছেলেকেও মারধর করা হয়।
ওই সময়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, একদল লোক দোকানের ভেতর বাবা-ছেলেকে মারধর করছে।
খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। এবং পরে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়।
তখন উত্তেজিত জনতা থানায় গিয়েও বিক্ষোভ করে এবং বাবা-ছেলের বিচার দাবি করে স্লোগান দেয়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে থানাতেও অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।
এইরকম পরিস্থিতিতে উত্তেজিত জনতার সামনে বক্তব্য দেন থানার ওসি নূরনবী।
একটি ভিডিওতে ওসিকে জনতার উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, “আপনারা যারা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আপনারাও মুসলমান, আমি থানার ওসি, আমিও মুসলমান। যে ঘটনা ঘটেছে তাতে আমারও কলিজায় আগুন লেগেছে। আপনার মত আমারও চোখে পানি এসেছে। বাংলাদেশে এমন মামলা দেব, যাতে তাদের যাবজ্জীবন বা ফাঁসি হয়।”
রোববারের ওই বক্তব্যের ভিডিওটি মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্য হয়ে ওসি এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন কি-না।
যদিও ওসি নূরনবী সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, ঘটনার সময়কার উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন। এখানে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ছিল না।
স্থানীয় সিপিবি নেতা অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম অপু বলেন, “একজন আইনের লোক হয়ে এ ধরনের কথা বলা একেবারেই দুঃখজনক। বিষয়টির তদন্ত না করেই এমন কথা বলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
এ ধরনের ‘মব সৃষ্টিকারী’ তিনি যেই হোন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন আইনজীবী রফিকুল ইসলাম অপু।
রোববার বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মারপিটের ঘটনা ঘটলেও আসলে দুদিন আগে শুক্রবার ঘটনার শুরু হয়েছিল বলে পরিবারের ভাষ্য।
তারা বলছেন, সেদিন এক তরুণ দোকানে চুল কাটতে গিয়েছিলেন। চুল কেটে টাকা কম দেওয়া নিয়ে পরেশ ও ছেলে বিষ্ণুর সঙ্গে তার বিতণ্ডা হয়। তখন সেই তরুণ ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন। এবং সেই তরুণই দুদিন পরে লোকজনকে নিয়ে এসে ঘটনা ঘটান।
কারাগারে থাকা বিষ্ণু চন্দ্র শীলের স্ত্রী দিপ্তী রানী শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে এসব অভিযোগ করেছেন। বুধবার সকালে তিনি বলেন, এরই মধ্যে কারাগারে গিয়ে তিনি স্বামী ও শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং কথা বলেছেন। তার শ্বশুর পরেশ চন্দ্র শীল তাকে এসব কথা বলেছেন।
দিপ্তী রানী শীল বলছিলেন, “আমার স্বামী ও শ্বশুর নির্দোষ। শুক্রবার একজন গ্রাহকের সঙ্গে চুল কাটানো নিয়ে তাদের সামান্য তর্ক হয়েছিল। দুদিন পর ঘটনাটি ধর্মীয় ইস্যু বানিয়ে আমাদের ওপর হামলা করা হয়।
“এখন আমার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।”
অপরদিকে মামলার বাদী মো. আবদুল আজিজ বলেন, “ওই দুই ব্যক্তি নবী করিম (সা.) ও তার স্ত্রীদের নিয়ে কটূক্তি করেছেন। মুসল্লিদের সামনে তারা ভুল স্বীকারও করেছেন। এখন পরিবারের সদস্যরা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।”
লালমনিরহাট গোশালা বাজারের ব্যবসায়ী রাশেদুল ইসলাম বলেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। অহেতুক কেউ যেন শাস্তি না পায় সেই বিষয়টিও সবার মাথায় রাখা উচিত।”
আরও পড়ুন:
লালমনিরহাটে 'সংখ্যালঘু' বাবা-ছেলের ওপর 'মব সন্ত্রাস' এর বিচার দাবি আসকের