Published : 05 Jul 2023, 09:22 AM
জুনের শুরুতে গোটা দেশ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠা, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস ওয়েল আমদানির ক্ষেত্রে প্রাপ্যতা নিশ্চিত না হওয়াসহ নানা কারণে তৈরি হয় বিদ্যুৎ সংকট।
সে সময় তীব্র গরম ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে শুরু হয় লোডশেডিং। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ, সব ধরনের শিল্পেই ভারি প্রভাব ফেলে এটি। বিপর্যয়ের মুখে পড়ে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পও।
বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কারণে প্রতিটি শাড়ির উৎপাদন খরচ বাড়লেও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারছেন না তাঁতীরা। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অচলাবস্থা। যার কারণে ব্যাংক ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া বিভিন্ন আকারের ঋণ পরিশোধ করাই এখন তাঁতীর মূল চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কথা হয়, জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, নলশোঁধা, বড়টিয়া, মঙ্গলহোড়, চিনাখোলা ও পার্শ্ববর্তী সদর উপজেলার তাঁত শিল্প খ্যাত গ্রাম ধুলটিয়াসহ কালীহাতি উপজেলার বল্লা-রামপুর গ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের তাঁতীদের সঙ্গে।
তারা বলছেন, মূলত লোডশেডিংয়ের কারণেই এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে পূজার বাজার অনুযায়ী প্রত্যাশিত শাড়ি তৈরি অসম্ভব হয়ে উঠবে। যদিও ঈদের বন্ধে লোডশেডিং কমেছে, কিন্তু শ্রমিকরা সব বাড়ি গেছেন। ফলে এখন চাইলেও আর মেশিন চালু করার সুযোগ নেই।
সাধারণত টাঙ্গাইলে তাঁতের শাড়ি তৈরি হয় দুধরনের মেশিনে। এগুলো হলো পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম। পাওয়ারলুমের মেশিন চলে বিদ্যুতে। হ্যান্ডলুম হাতে টানা মেশিন হলেও এতে কাপড় বোনার সময় ঘরে উজ্জল আলোর প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ দুটি যন্ত্রেই কাপড় তৈরির জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য।
অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে মেশিন ও বাতি চালু রাখতে জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। ফলে জেনারেটরের তেলের খরচও যুক্ত হয়েছে শাড়ির উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে।
তাঁত মালিক মো. রিপন মিয়া বলেন, “এমনিতেই শাড়ীর ব্যবসা মন্দা। এর মধ্যে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দুঃশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ঋণ পরিশোধের পরিবর্তে আমাদের আরও ঋণগ্রস্ত হতে হবে।”
দিনরাত মিলিয়ে ১০-১২ বার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করায় বিদ্যুৎচালিত লাখ টাকার পাওয়ারলুম তাঁতগুলো নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও করছিলেন সংশ্লিষ্টরা।
শাড়ী ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, গত রোজার ঈদে আশানরূপ বেচা-কেনা হয়নি। পূজাকে সামনে রেখে ঘাটতি পূরণ করতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু কোরবানির ঈদের মাসেই বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকট সেই লক্ষ্য পূরণে প্রধান বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যদিও এখন সেই সমস্যা আগের চেয়ে কিছুটা কম।
তিনি বলেন, “যাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছি তাদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ভীষণ বিপাকে পড়তে হবে।”
কোভিড মহামারী পরবর্তী পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার আগেই বিদ্যুতের সংকট টাঙ্গাইলের তাঁতীদের বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বলে জানালেন তারা। আগে টাঙ্গাইল থেকে ভারতীয় ক্রেতারাও শাড়ি কিনতেন, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কোভিডের পর থেকে সেটিও বন্ধ। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছে তাঁতী পরিবারগুলো।
বারবার লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে শাড়ী উৎপাদন করতে হয়েছে জানিয়ে তাঁত মালিক হাজি ময়নুল হোসেন বলেন, “ফলে আমার প্রতি মাসে ৮-১০ হাজার টাকার জ্বালানি তেল কিনতে হয়েছে। এতে শাড়ীর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু বর্ধিত খরচে শাড়ী বিক্রি করতে পারছি না।”
শ্রমিকরাও জানালেন উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা। আগে যেখানে দিনে পাওয়ার লুমে ৩-৪টি শাড়ি তৈরি করতে পারতেন, এখন একটি করাই কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানালেন তারা।
তবে ভিন্ন কথা বললেন পাথরাইল শাড়ী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক।
তিনি বলেন, “এমনিতেই শাড়ী-কাপড় বিক্রি হচ্ছে না। বিদ্যুৎ থাকলে উৎপাদন বেড়ে যেত। লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন কম হওয়ায় মালিকপক্ষের ঝুঁকি কমে যাচ্ছে।”
সরকার শুধু তাঁতীদের দুঃখের কথা শুনে যায়, সমাধানে পদক্ষেপ নেয় না বলেও অভিযোগ করলেন তিনি।
রঘুনাথ বসাক বলেন, “এর আগে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসেছিলেন। তাদের কাছে আমাদের দাবি ছিল, সরকারি অফিসগুলোয় নারী কর্মকর্তাদের যেন শাড়ী পরিধান বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়নি।”
তাঁতীরা ভর্তুকি চান না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা চাই, তাঁতীদের উৎপাদিত শাড়ি কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারিভাবে কিনে নেওয়া হোক। এতে প্রান্তিক তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা উপকৃত হবে। বেঁচে থাকবে তাঁত শিল্প।”