Published : 04 Aug 2023, 01:23 PM
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুরের উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত ঘাঘট নদী পারাপারে ১৫ গ্রামের মানুষের ভরসা ছোট্ট এক নৌকা।
উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়ন ছাড়াও নদীর পূর্ব-পশ্চিমে জামালপুর ও রসুলপুর ইউনিয়ন। দৈনন্দিন কাজে ছোট নৌকা দিয়েই দীর্ঘ দিন ধরে ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার হতে হচ্ছে ওই তিন ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের প্রায় ১৫ লাখ মানুষের।
সরেজমিনে দিয়ে দেখা যায়, উপজেলা শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে জামালপুর ইউনিয়নের চকশলাইপুর ও দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাঙ্গামোড় গ্রাম। এই দুই গ্রামের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে ঘাঘট নদীটি।
নদীটির যেখান দিয়ে নৌকায় পারাপার হতে হয় সে স্থানটির নাম মাদারের ঘাট। ঘাটে বাঁধা থাকে একটিমাত্র ছোট্ট ডিঙি। যাতে ছয়-সাতজনের বেশি যাত্রী ধরে না। জনপ্রতি পাঁচ টাকায় লোক পারাপার হতে হয়। কিন্তু কোনো যানবাহন পারাপারের সুযোগ নেই।
তিন ইউনিয়নের গ্রামগুলোর মানুষ নিত্যদিন নৌকায় ঘাঘট পারাপারে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
গ্রামগুলো হচ্ছে: জামালপুর ইউনিয়নের চকশলাইপুর, চকদাড়িয়া, শ্রীকলা, গোপালপুর ও পাতিল্যারকুড়া। রসুলপুর ইউনিয়নের মহিষবান্দি ও বৈষ্ণবদাস। দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাঙ্গামোড়, মধ্য ভাঙ্গামোড়, খুনিয়াপাড়া, মরুয়াদহ, কিশামত দশলিয়া, দামোদরপুর, লালবাজার ও নিয়ামতনগর।
বুধবার সকালে চকশলাইপুর, চকদাড়িয়া ও শ্রীকলা গ্রামের ৬-৭ শিক্ষার্থী ছোট্ট নৌকায় নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে দেখা যায়।
কথা বলে জানা যায়, এরা সবাই ভাঙ্গামোড় দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী চকদাড়িয়া গ্রামের জেসমিন আক্তার জানায়, তাদের গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। তাই লেখাপড়ার জন্য নদী পার হয়ে তাদের গ্রামের ছেলে-মেয়েরা ওই পাড়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়।
একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী মহিষবান্দি গ্রামের মো. ছাব্বির ইসলাম জানায়, নদীর পূর্ব পাড়ে নিয়ামত নগর ফাজিল মাদ্রাসা, নিয়ামত নগর হাইস্কুল, ভাঙ্গামোড় দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, কান্তানগর উচ্চ বিদ্যালয়সহ ৫-৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থী প্রতিদিন ছোট নৌকায় এই নদী পার হয়ে যাওয়া-আসা করে।
একই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শ্রীকলা গ্রামের সোনিয়া খাতুন জানায়, এই ঘাটে একটিমাত্র ছোট নৌকা। পাঁচ-ছয় জনের বেশি উঠলে দোল খায়। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে তাদের যেতে হয়।
একই গ্রামের কলেজছাত্র শফিউল আলম বলেন, বর্ষায় নদীতে স্রোত থাকে। তখন পারাপার ঝুঁকিপূর্ণ। তাই শিক্ষার্থী ছাড়াও নারী-শিশু-বয়স্ক ও অসুস্থদের নিরাপদ যাতায়াতে পাকা সেতুর প্রয়োজন।
চকশলাইপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরিনা পারভীন বলেন, ইউনিয়ন দুটির সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী ঝুঁকি নিয়ে এই নদী পারাপার হয়। অনেক অভিভাবক শিশু- শিক্ষার্থীকে নদী পার করে দিয়ে যান।
ভাঙ্গামোড় দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধানশিক্ষক শহিদুল ইসলাম নান্নু মিয়া বলেন, শুধু শিক্ষার্থী ও তিন ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের লোকজনই নন। সাদুল্লাপুর উপজেলার কামারপাড়া ও গাইবান্ধা সদরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মাদারগঞ্জ হাটে এই খেয়াঘাট দিয়ে যাতায়াত করেন। এতে তাদের ৮-৯ কিলোমিটার পথ কম পারি দিতে হয়।
দক্ষিণ ভাঙ্গামোড় গ্রামের মোছা. রশিদা বেগম (৫৫) নামে এক কৃষানি বলেন, “নদীর ওপারোত হামাঘর জমি আচে। কিনতো হামরা নাংগোল, মই ও গরু নিয়া নদী পার হবার পাইনে। জমির ধান, পাট ও গমসহ নানান ফসল অনেক কসটো করি নিয়ে আসা নাগে।
“শুকনা দিনোত কসটো করি নদী পার হয়্যা ওই পাড়ের যাওয়ান যায়। কিন্তুক নদীত পানি বাড়লে মেলা পথ ঘুরি যাওয়া নাগে।”
চকদাড়িয়া গ্রামের মহির উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী জানান, এখানে সেতু না থাকায় চার কিলোমিটার ঘুরে মহিষবান্দি বাজার হয়ে সাদুল্লাপুর উপজেলা শহর থেকে ব্যবসায়ের মালামাল আনতে হচ্ছে। ফলে পরিবহন খরচ বেশি পড়ছে তার।
চকশালাইপুর গ্রামের পানের দোকানি জরিপ মিয়া (৪২) বলেন, “একন্যা বিরিজের (সেতু) জন্য হামরা তো পোরশাসনের (প্রশাসন) কাচে যাবার পাইনে। তাই চেরম্যানের পিছনোত ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হয়া গেচি, কিনতো বিরিজ হয় নাই।”
জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাওছার হাসান মণ্ডল বলেন, এই ঘাঘট নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জন্য উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় একাধিকবার বলা হয়েছে। এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।
একই কথা বললেন দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম।
সাদুল্লাপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাহারিয়া খান বিপ্লব বলেন, “এখানে সেতু নির্মাণ করা জরুরি। এ জন্য এলজিইডিকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।”
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) গাইবান্ধা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম বলেন, “এই ঘাঘট নদীর ওপর পাকা সেতু নির্মাণে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রকৌশলীকে প্রকল্প তৈরি করতে বলা হয়েছে।”