Published : 05 Jul 2025, 05:42 PM
পশ্চিম ভারতের কোলাপুর শহর হঠাৎ করেই যেন বিশ্বজুড়ে অপ্রত্যাশিত এক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে।
সেখানকার হাজার হাজার কারিগর, যারা ঐতিহ্যবাহী চামড়ার স্যান্ডেল হাতে তৈরি করেন, তারা একযোগে ইতালির বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাদার বিরুদ্ধে উৎস স্বীকার না করে স্যান্ডেলের নকশা চুরির অভিযোগ এনে তুমুল প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
ম্লান আলোয় আচ্ছাদিত ৫৮ বছর বয়সী সদাশিব সানাকের ছোট কারখানা থেকে আসা ছন্দময় হাতুড়ির শব্দ জানান দিচ্ছিল চামড়া দিয়ে ঐতিহ্যবাহী কোলাপুরি স্যান্ডেল বানানোর কঠিন পরিশ্রমের উপাখ্যানের।
“ছোটবেলাতেই আমি এই কারিগরি কাজ শিখেছি,” তিনি বলেন বিবিসিকে। দিনে আট থেকে দশ জোড়া স্যান্ডেল তৈরি করতে পারেন তিনি, যেগুলোর দাম বড়জোর ৮ থেকে ১০ ডলার।
এখন কোলাপুরে ৫ হাজারের মতো কারিগর এই পেশায় রয়েছেন। ঘরোয়া এই শিল্প আধুনিক যন্ত্রনির্ভর বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এমনিতেই ধুঁকছে; সঙ্গে রয়েছে দারিদ্র্য, বাজে কর্মপরিবেশ আর নামমাত্র মজুরির ধাক্কা।
তার মধ্যেই প্রাদা যখন তাদের নতুন স্যান্ডেল বাজারে আনে, যেটা দেখতে কোলাপুরি স্যান্ডেলের মতোই, কিন্তু কোথাও এর নকশার উৎসের কথা উল্লেখ নেই, তখন স্থানীয় পাদুকাশিল্পীরা ক্ষিপ্ত না হয়ে পারেননি।
এর প্রতিক্রিয়াও হয় তীব্র। সাংস্কৃতিক জবরদখলের অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরগরম হয়ে ওঠে। তড়িঘড়ি বিবৃতি দিয়ে প্রাদা স্যান্ডেলের উৎসের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
এখন স্থানীয় রাজনীতিক ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা কোলাপুরি স্যান্ডেলের কারিগরদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। তারা এই শিল্প এবং এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছেন।
বিবিসির দেখানো ভিডিওর আগে প্রাদার শো সম্পর্কে জানতেন না সানাকে। তাকে যখন বলা হল, এই স্যান্ডেলগুলো বাজারে শত শত পাউন্ডে বিক্রি হতে পারে, তখন অনেকটা উপহাসের সুরেই জানতে চান, “ওগুলোতে কি সোনা থাকে?”
প্রাদা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের এই স্যান্ডেলের দাম জানায়নি। তবে তাদের ওয়েবসাইটে অন্যান্য স্যান্ডেলের দাম দেখাচ্ছে ৬০০ থেকে ১,০০০ পাউন্ডের মধ্যে, বাংলাদেশি টাকায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা।
কোলাপুরি স্যান্ডেলের নাম পাওয়া গেছে দ্বাদশ শতকের নিদর্শনেও।
“এই স্যান্ডেলগুলো মূলত বানাতো প্রান্তিক চর্মকার সম্প্রদায়ের সদস্যরা, যারা চামার নামেও পরিচিত,” বলেন কোলাপুর নিউ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক কবিতা গাগরানি।
চামার শব্দটি একটি অবমাননাকর বর্ণবাদী শব্দ, যা পশুর চামড়া নিয়ে কাজ করা দলিত সম্প্রদায়কে (আগে এরা অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ নামেও পরিচিত ছিল) বোঝাতে ব্যবহৃত হতো।
“কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কোলাপুরের শাসক ছত্রপতি শাহু মহারাজ এই সম্প্রদায়কে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেন,” বলেন গাগরানি।
আজ, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় এক লাখ পাদুকাশিল্পী এই কোলাপুরি স্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত, এর বাজারমূল্যও ২০ কোটি ডলারের বেশি, বলছে মহারাষ্ট্র চেম্বার অফ কমার্স, ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড এগ্রিকালচার (এমসিসিআইএ)।
এরপরও, এই শিল্পীদের বেশিরভাগই অসংগঠিত সেটআপ নিয়ে অমানবিক পরিস্থিতিতে কাজ করছেন।
“আমি কোনোদিন স্কুলে যাইনি। এই কাজই জানি। দিনে সর্বোচ্চ ৪-৫ ডলার রোজগার হয়, তাও অর্ডারের ওপর ভিত্তি করে,” বলেন ৬০ বছর বয়সী সুনিতা সাতপুতে।
তার মতো নারীরা এই শিল্পে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, বিশেষ করে স্যান্ডেলে হাত দিয়ে সূক্ষ্ম নকশা আঁকার ক্ষেত্রে, কিন্তু তাদের এই দীর্ঘ শ্রমের উপযুক্ত পানিশ্রমিক মেলে না, জানান সুনিতা।
এ কারণেই তার সন্তানরা আর এই পেশায় আসতে চায় না।
তার কারখানার কাছেই রয়েছে কোলাপুরের বিখ্যাত ‘চপ্পল গলি’— সেখানকার সারি সারি ছোট ছোট দোকানের অনেক বিক্রেতাকেই এখন টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
“চামড়া অনেক দামি হয়ে গেছে প্রচণ্ড বেড়েছে, আমাদের খরচও বেড়ে গেছে,” বলেন চপ্পল গলিতে দোকান খোলা প্রথম বিক্রেতাদের একজন অনিল দইপোড়ে।
এই কোলাপুরি স্যান্ডেল বানাতে কারিগররা গরু বা মহিষের চামড়াই ব্যবহার করে আসছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গরু জবাইয়ের অভিযোগে তথাকথিত গোরক্ষকদের আক্রমণের ঘটনা বেড়ে গেছে।
২০১৫ সালে মহারাষ্ট্র রাজ্য গরু জবাই, গরুর মাংস বিক্রি ও খাওয়া নিষিদ্ধ করে, ফলে কারিগরদের বাধ্য হয়ে অন্য রাজ্য থেকে মহিষের চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে, যা তাদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিক্রেতাদের লড়তে হচ্ছে বাজারে সয়লাব হয়ে যাওয়া সিন্থেটিকের নকল স্যান্ডেলের সঙ্গেও।
“ক্রেতারা সস্তায় স্যান্ডেল চান এবং সবসময় আসল-নকল আলাদাও করতে পারেন না,” বলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের কোলাপুরি স্যান্ডেল ব্যবসায়ী রোহিত বালকৃষ্ণ গাভালি।
এই খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাদার স্যান্ডেল নিয়ে বিতর্ক দেখিয়ে দিয়েছে যে কোলাপুরি স্যান্ডেল কারিগরদের অধিকার রক্ষায় আরও উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রয়োজন।
২০১৯ সালে ভারত সরকার কোলাপুরি স্যান্ডেলকে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে স্যান্ডেলের নাম ও নকশাকে ভারতের মধ্যে আইনি সুরক্ষা দেওয়া হল, যেন বাইরের কেউ বিনা অনুমতিতে এগুলো ব্যবহার করতে না পারে।
কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এমন কোনো কার্যকর সুরক্ষা আইন নেই, যা অন্য কোনো দেশ বা ব্র্যান্ডকে একই নকশার নান্দনিক অনুকরণ থেকে বিরত রাখতে পারে।
মুম্বাইয়ের আইনজীবী ঐশ্বরিয়া সন্দীপ বলেন, ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির আওতায় প্রাদার বিষয়টি তুলতে পারে। ভারত এ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ।
কিন্তু বিষয়টি তোলা এবং এর অধীনে ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রক্রিয়া জটিল, ব্যয়বহুল এবং ভারতে ও অন্যত্র সবসময় কার্যকরভাবে প্রয়োগও করা যায় না, বলেন ঐশ্বরিয়া।
এমসিসিআইএ-এর সভাপতি ললিত গান্ধী বলেন, তারা কোলাপুরি স্যান্ডেলের নকশা পেটেন্ট করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ভবিষ্যতের জন্য আইনি দৃষ্টান্ত তৈরির উদ্দেশ্যে।
যদিও অনেকে মনে করেন, প্রকৃত পরিবর্তন তখনই আসবে যখন ভারত নিজ ঐতিহ্যের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে।
“এটা নৈতিক স্বীকৃতির বিষয়। ভারতকে রয়্যালটি ভাগাভাগি ও যৌথ ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য চাপ দিয়ে যেতে হবে। আমরা যত বেশি আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করবো, তত কম শোষিত হবো,” বলেছেন স্বনামখ্যাত ডিজাইনার ঋতু বেরি।
অবশ্য, এবারই যে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতীয় হস্তশিল্প নকলের অভিযোগ উঠল, এমন নয়।
অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ডই ভারতীয় কাপড় বা এমব্রয়ডারি কাজ ব্যবহার করে থাকেন কিন্তু প্রকৃত শিল্পীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করেন না। “চিকনকারি (উত্তর ভারতের লক্ষ্ণৌর সূক্ষ সূচিকর্মশৈলী), ইকাত (সুতায় রং দিয়ে কাপড় বোনার পদ্ধতি), আয়নার কাজের কথাই ধরুন—তারা সবই বারংবার ব্যবহার করেছে। কিন্তু হস্তশিল্পীরা রয়েছেন অদৃশ্য হয়েই, আর এদিকে ব্র্যান্ডগুলো তাদের কাজ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে দুহাতে টাকা কামাচ্ছে,” বলেন ঋতু বেরি।
তবে ললিত গান্ধী মনে করেন, কোলাপুরি স্যান্ডেল নিয়ে প্রাদার স্বীকৃতি পাদুকাশিল্পীদের জন্য ইতিবাচকও হতে পারে।
“তাদের পর্যায়ে যাওয়ায়, কোলাপুরি স্যান্ডেলের দাম অনেকগুণ বেড়ে যাবে। আমরা চাই তাদের মুনাফার কিছু অংশ যেন পাদুকাশিল্পীদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় হয়।”
কোলাপুরের স্যান্ডেল বিক্রেতা রোহিত গাভালি বলছেন, তিনি ইতোমধ্যেই খানিকটা পরিবর্তন খেয়াল করছেন।
“প্রাদা যে নকশাটি ব্যবহার করেছে, সেটি খুব একটা জনপ্রিয় নয়। কিন্তু লোকজন সেটাই চাইছে। দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র আর কাতার থেকে ক্রেতারা অর্ডার দিচ্ছেন।
“কখনও কখনও বিতর্ক কাজে দেয়। তবে সেটা যদি সম্মান আর যারা এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন তাদের জন্য ভালো দাম নিয়ে আসে, তাহলে বেশ ভালো হয়,” বলেছেন তিনি।
কোলাপুরি স্যান্ডেলের এই বিতর্ক এত দ্রুত শেষ হচ্ছে না।
আপাতত হাই কোর্টে একটি মামলা হয়েছে, যাতে প্রাদার কাছে ক্ষতিপূরণ এবং আদালতের তত্ত্বাবধানে ইতালির এই ব্র্যান্ড ও পাদুকাশিল্পীদের সংগঠনগুলো যেন একসঙ্গে কাজ করে তা চাওয়া হয়েছে।
প্রাদা বিবিসিকে বলেছে, তারা এ বিষয় নিয়ে মহারাষ্ট্র চেম্বার অফ কমার্স, ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড এগ্রিকালচারের (এমসিসিআইএ) সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
দুই পক্ষের মধ্যে আগামী সপ্তাহে একটি বৈঠক হবে, জানিয়েছেন এমসিসিআইএ-র সভাপতি ললিত গান্ধী।