Published : 08 Jul 2025, 05:18 PM
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ, চিন্তাশক্তির প্রসার ও জ্ঞানার্জনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারত বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার। বই, জার্নাল, গবেষণা সামগ্রী কিংবা সাহিত্যপাঠ—এসবের মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের চেতনার জগৎ সমৃদ্ধ হওয়ার কথা, তাদের মধ্যে জ্ঞান অন্বেষণের স্পৃহা জাগ্রত হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে দেশের হাজার হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার কেবলমাত্র একটি রেজিস্ট্রারের পাতায় ঠাঁই পাওয়া নামমাত্র অস্তিত্ব। এই পুস্তকবিহীন গ্রন্থাগারগুলোর কার্যক্রম নেই বললেই চলে এবং এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এক করুণ চিত্র তুলে ধরে।
১৯৭৪ সালের কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে বিদ্যালয় গ্রন্থাগারকে—শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হৃদপিণ্ড বলা হয়েছিল। এই উক্তিটি একটি সচল গ্রন্থাগারের গুরুত্বকে স্পষ্ট করে, যা শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়—সমগ্র মানবিক উন্নয়নের কেন্দ্রে অবস্থান করে। একটি কার্যকর গ্রন্থাগার শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলে, তাদের জিজ্ঞাসু মনকে প্রসারিত করে এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। এটি জ্ঞান অর্জনের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অন্বেষণ করতে পারে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজকের বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিক এক ধোঁয়াশায় রূপ নিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান জানেনই না, এই পদটি কী কাজ করে! তাদের কাছে গ্রন্থাগারিক কেবল একটি অতিরিক্ত বোঝা, যার কোনো সুস্পষ্ট দায়িত্ব নেই। অনেক শিক্ষক মনে করেন, গ্রন্থাগার মানেই বসে থাকা এক অনুৎপাদনশীল কর্মী, যাকে দিয়ে অন্য কাজ করানোই ভালো। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রন্থাগারিকদের ক্লাসরুম পাঠদানে বা প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত রাখা হয়, যা তাদের মূল দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত করে।
গ্রন্থাগারিকদের পেশাগত পদবি—সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান) হলেও তারা অধিকাংশ সময়েই পাঠদানে ব্যবহৃত হচ্ছেন, অথচ কোনো পাঠ্যক্রম, ক্লাস রুটিন, নির্ধারিত পাঠ্যবই কিছুই তাদের জন্য নেই। এটি একদিকে যেমন তাদের পেশাগত দক্ষতার অপচয়, তেমনই অন্যদিকে গ্রন্থাগারিক হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করে। সচল গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য নেই নির্দিষ্ট কক্ষ, নেই বইয়ের শ্রেণিবিন্যাস বা ক্যাটালগিং ব্যবস্থা, নেই পাঠক রেজিস্ট্রার, এমনকি শিক্ষার্থীদের কাছে বই দেওয়ারও নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা। অর্থাৎ, গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং প্রক্রিয়াগত ভিত্তিই অনুপস্থিত।
দেশের গ্রন্থাগারিকদের নিয়োগ একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও এর পেছনে লুকিয়ে থাকা অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। বেশ কয়েকজন সচেতন অভিভাবক এবং শিক্ষক আলাপকালে জানান, অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান গ্রন্থাগারের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ নিজের স্বার্থে অন্য খাতে ব্যয় করেন কিংবা সরাসরি আত্মসাৎ করেন। বই কেনার নামে যে টেন্ডার হয়, তাতে রাজনৈতিক প্রভাবশালী লেখকদের নিম্নমানের বই কিনে পাঠানো হয়, যা শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে আসে না। এসব বই কেবল তাক ভরার কাজ করে, জ্ঞানচর্চার অনুপ্রেরণা জাগায় না। ফলে স্কুলের গ্রন্থাগার হয়ে ওঠে একরাশ ধুলোমাখা, তালাবদ্ধ কক্ষ—যার চাবিও হয়তো হারিয়ে গেছে বহু বছর আগে।
এটি কেবল অর্থের অপচয় নয়, এটি শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকারের প্রতি চরম অবহেলা। যখন সরকার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে, তখন এই ধরনের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা সেই সকল প্রচেষ্টাকে অর্থহীন করে তুলছে।
সরকারিভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ২০২৩ সালে স্কুল-কলেজে লাইব্রেরি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা দিলেও তার কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। আদেশে বলা হয়েছিল—শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই নিয়মিত গ্রন্থাগারে পাঠ করবেন; গ্রন্থাগার হবে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার নির্ভরযোগ্য স্থান। সেখানে বইপড়া, রচনা, কুইজ, বিতর্ক, দেয়ালপত্রিকা, গল্প বলা, জাতীয় দিবস পালন—এই সবকিছু হবে লাইব্রেরি-কেন্দ্রিক প্রাণবন্ত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ। এই নির্দেশনা যুগান্তকারী হতে পারত, কিন্তু অধিকাংশ বিদ্যালয়ে তা আদেশপত্রেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এটি প্রধান শিক্ষকদের উদাসীনতা ও বাস্তবায়ন অনীহার প্রতিফলন।
এই নির্দেশনা যদি কার্যকর হতো, তাহলে বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলো প্রাণ ফিরে পেত। শিক্ষার্থীরা কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাইরের জগতের জ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারত। কিন্তু নির্দেশনার বাস্তবায়ন না হওয়ায় গ্রন্থাগারগুলো তাদের নিষ্প্রাণ অস্তিত্ব নিয়েই রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে গ্রন্থাগারিকদেরও কিছু দায় অস্বীকার করা যায় না। অনেকেই বলেন, "আমরা শুধু নামে গ্রন্থাগারিক, আমাদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি।" অথচ একজন সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান) গ্রন্থাগারের ব্যবস্থাপনা, পাঠক সেবা, বই সংগ্রহ, বিষয়ভিত্তিক ক্যাটালগ তৈরি, পাঠ কার্যক্রম চালু রাখা, এবং জ্ঞানভিত্তিক সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষায় একটি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা মূলত কর্তৃপক্ষের উদাসীনতারই ফল, যেখানে তাদের দায়িত্ব ও গুরুত্ব সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
একজন গ্রন্থাগারিকের কাজ দুই ভাগে ভাগ করা যায়, প্রথমত গ্রন্থাগার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা, দ্বিতীয়ত সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। প্রথমটির মধ্যে রয়েছে, গ্রন্থাগার কক্ষকে সুসজ্জিত ও ব্যবহারোপযোগী রাখা, পর্যাপ্ত আলো-হাওয়া নিশ্চিত করা, টেবিল-চেয়ার-বুকশেলফের ব্যবস্থা করা, বইয়ের তালিকা তৈরি ও হালনাগাদ রাখা, লেনদেনের রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করা, নতুন বই সংগ্রহ এবং পুরনো বই রক্ষণাবেক্ষণ করা। দ্বিতীয় অংশটি হলো সহশিক্ষা কার্যক্রম, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটিই পাঠক তৈরি করে। গল্পপাঠ, কবিতাচর্চা, বইমেলা, লেখক পরিচিতি, চিত্রাঙ্কন, চলচ্চিত্র আলোচনা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বই রিভিউ সেশন, এই সব আয়োজন শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং অনুসন্ধিৎসু মনোভাব জাগিয়ে তোলে।
বর্তমানে শিক্ষার্থীরা পাঠাভ্যাস হারিয়ে মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবমুখী হয়ে পড়ছে। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় তারা সহজেই অস্থির, হিংস্র ও সহিংস আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এটি ভয়াবহ এক সামাজিক সমস্যা, যা তাদের মূল্যবোধ, মনন ও সৃজনশীলতার বিকাশে বাধা দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশের স্কুলে সচল গ্রন্থাগার রয়েছে, সেসব দেশের শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তি, যুক্তিবোধ ও বিশ্লেষণক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি বিকশিত। অথচ আমাদের দেশে কার্যকর গ্রন্থাগার না থাকায় ছাত্ররা বইপাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারছে না এবং তাদের মনোজগৎ দারুণভাবে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।
শুধু শহরের কিছু বেসরকারি বা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বইকেন্দ্রিক কিছু কার্যক্রম দেখা গেলেও, দেশের প্রায় ২১ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশই কার্যত গ্রন্থাগারবিহীন, গ্রন্থাগারিকবিহীন বা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।
একদিকে লক্ষ কোটি টাকা বই কেনার নামে ব্যয় করা হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী একটি বইও সেই গ্রন্থাগারে রাখা হচ্ছে না। এই অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ফেলছে। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর যদি সত্যিকারের শিক্ষাবিকাশ চায়, তবে বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার উন্নয়নকে শীর্ষ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এর জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন:
প্রথমত, প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব নির্ধারণ করে একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এতে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পাঠ্যসূচি এবং কার্যক্রম যুক্ত থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, গ্রন্থাগার পাঠকে বাধ্যতামূলক ক্লাস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বইপাঠে অংশ নেয় এবং গ্রন্থাগারকে শিক্ষার অংশ হিসেবে দেখে।
তৃতীয়ত, লাইব্রেরি বাজেটের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বই সংগ্রহ ও গ্রন্থাগার উন্নয়ন ছাড়া এই অর্থ যেন অন্য কোনো খাতে না যায়, তা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে।
চতুর্থত, স্থানীয় সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে গ্রন্থাগারগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও কার্যকারিতা বাড়বে।
পঞ্চমত, অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। প্রতিটি বিদ্যালয়ে আলাদা কক্ষ, আলো-বাতাস, আসবাব, নিবন্ধন খাতা, প্রাসঙ্গিক বই ও সাহিত্য সংরক্ষণের উপযোগী পরিবেশ থাকতে হবে।
শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি না করে শুধু পাঠ্যবই দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া মানে তাদের ভবিষ্যৎ মেধা ও মননকে বন্দি করে রাখা। সেই দিক থেকে একটি সচল গ্রন্থাগার হলো মুক্তির দরজা। এটি কেবল জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র নয়, বরং চিন্তার পরিধি ও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরির একটি চর্চাগার। এই দরজা খুলে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার, বিশেষ করে শিক্ষা খাতের নীতিনির্ধারকদের।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেবল নম্বর ও সনদ-ভিত্তিক না রেখে মানবিক, চিন্তাশীল ও সচেতন মানুষ গড়ার দিকে যেতে হবে। আর এই পথে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে একটি সচল বিদ্যালয় গ্রন্থাগার। এখনই সময় এই বাস্তবতা স্বীকার করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার।