Published : 06 Jun 2025, 01:58 AM
“মারার এক পর্যায়ে আমি মনে হয় টেবিলের কোনা বা কিছুতে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেছি, জ্ঞান হারাইছি। পরে আমারে বাথরুমে মাথায় পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরাইছে। এক হাত আমার অবশ। আমি দাঁড়াইতে পারি না। মানে সোজা দাঁড়াইতে পারি না।
“এমন অবস্থা যে, দাঁড়াইলেই আর বসতে পারি না। বসলে আর দাঁড়াইতে পারি না। বাথরুমে আমাকে নিয়ে গেছে।...লজ্জাকর বিষয়- তারপরও একটু বলতে হচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে বাথরুমে, মানে আমি পারতেছি না। এই অবস্থায় আমাকে আবার মারধর করা হয়।”
মারধরের মধ্যে গোপন বন্দিশালায় আটক ওই ভুক্তভোগীকে দুইজন ব্যক্তির নাম জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ’জানেন না’ বলে উত্তর দেন। তার মুখ দিয়ে তখন স্বর বের হচ্ছিল না।
এমন অবস্থায় তাকে আবার মারধর করা হয়। ওই ব্যক্তি সেদিনের নির্যাতনের বর্ণনায় বলেন, “যখন আমি কোনো আওয়াজ করতে পারতেছি না, তখন আমি এতটুকু শুনতেছি, ’মরে গেল কি না দেখ, মরে গেছে কি না।’ একজন লাথি দিয়ে দেখতেছে, এর মধ্যে আবার চোখ খুলে আমি দেখতেছি, এমনে তাকায় রইছি।“
এভাবেই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সময়ে ‘গুমের’ শিকার হওয়ার দাবি করা এক ব্যক্তি তার একদিনের নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন গুম তদন্ত কমিশনের কাছে।
তার জবানিতে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বীকারোক্তি আদায়ে সেদিনের ওই সময়ের মারধর ওখানেই শেষ হয়নি।
ঘটনার বর্ণনা অব্যাহত রেখে ওই ব্যক্তি বলেন, “এর মধ্যে আমাকে কী করলো? গামছা দিয়ে মুখে পানি ঢাললো। ‘কোথায় আছে, কোথায় আছে, বল, কোথায় আছে বল?’ মানে আমাকে একটা সেকেন্ডও সময় দিতাছে না।... ওরা কয়, ’না, তোর বলতে হইব। এখন কোথায় আছে, কোথায় গেলে পাব’?”
এরপর গ্রিলের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা ও বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার বর্ণনা দেন ২০১৭ সালে র্যাবের হাতে ১১৩ দিন গুম থাকা ওই ভুক্তভোগী।
তার মত আরও অনেকের অভিযোগ ও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম তদন্ত কমিশন গত বুধবার দ্বিতীয় দফায় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
এতে দৈনন্দিন নির্যাতন ও বন্দি করে রাখা জায়গার অমানবিক বর্ণনা ভুক্তভোগীদের বরাতে তুলে ধরা হয়েছে।
একজন বন্দির বরাতে তাকে আটকে রাখার জায়গাটির বর্ণনায় বলা হয়েছে, একজন মানুষ শুধু লম্বা হয়ে পিঠ পাততে পারেন এমন ছোটো একটি খোপ, যার এক মাথায় নিচু কমোড। সেই কমোডের সামনে-পেছনের জায়গা এত ছোট যে, মলমূত্র ত্যাগ করলে তা বাইরেই পড়ে। সেখানে আবার সব সময় চালু থাকে সিসিটিভি ক্যামেরা।
এমন নোংরা আর দুর্গন্ধের পরিবেশের মধ্যে ব্যক্তিগত লজ্জা নিবারণের পরিবেশ না থাকার মধ্যেই তাকে পার করতে হয়েছে দিন-রাত। সময়ে সময়ে নিয়ে করা হয় নানান কায়দায় মারধর, যৌনাঙ্গ কিংবা শরীরে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক শক।
কিছু ভুক্তভোগী বলেছেন, কখনও আবার ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে এমন তীব্রবেগে ঘোরানো হত যে, এমনিতেই মলমূত্র ত্যাগ হয়ে যায়; হতে হয় জ্ঞান হারা।
‘জোরপূর্বক’ তুলে নিয়ে যাওয়া ও ’গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের বরাতে এমন সব অমানবিক, নিষ্ঠুর ও নির্মম কায়দায় চালানো নির্যাতনের অনেকগুলো ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে গুম কমিশনের এই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।
তাদের বরাতে গুম কমিশন বলছে, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী সময়ে অসময়ে তাদের তুলে নিয়ে যেত। স্বীকারোক্তি আদায়ে চলত ভয়াবহ ও নির্মম নির্যাতন।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ‘গুম ও আয়নাঘরের’ বিষয়টি আবার সামনে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে এসব ঘটনা তদন্তে গত ২৭ অগাস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের গুম তদন্ত কমিশন গঠন করে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে বুধবার দ্বিতীয় এই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন তুলে দেয় কমিশন। যেখানে ‘গুমের’ শিকার ব্যক্তি এবং প্রত্যক্ষদর্শী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে সচিত্র বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এ প্রতিবেদনের ‘প্রকাশযোগ্য’ একটি অংশ সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়।
কমিশন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ পেয়ে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই বাছাই শেষে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
এর আগে কমিশন গত ১৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। পরদিন এ প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করা হয়।
অস্বস্তির চরম পর্যায়
নির্যাতনকেন্দ্রগুলোতে ভুক্তভোগীদের চরম অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হত। যার মধ্য দিয়ে ভিকটিমের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিত নির্যাতনকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গুম কমিশন বলছে, শারীরিক যন্ত্রণা, গোপনীয়তার অভাব এবং অব্যাহত মানসিক পীড়নের মধ্য দিয়ে বন্দিদের জন্য স্থায়ী দুর্দশার পরিস্থিতি তৈরি করা হত। যেখানে ছিল তাদের বেঁচে থাকা কিংবা সম্মানের ক্ষীণ সুযোগ।
“নির্যাতনের কায়দাগুলোর ব্যাপক ব্যবহার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর এটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। যার মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত মিলছে, এর অব্যাহত ও পদ্ধতিগত ব্যবহার করা হয়েছে ভুক্তভোগীকে ভয় ধরানো এবং তার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মিশ্রণে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘ অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা পেতেন। রক্ষীদের অর্ধেক পরিমাণ রেশন তাদেরকে দেওয়া হত, টানা হাতকড়া পরানো ও চোখ বাঁধা থাকত এবং নির্জন কারাবাসে রাখা হত।
“চরম বাজে অবস্থার সঙ্গে ভাগ্যের অনিশ্চয়তায় অব্যাহত দুর্দশার অভিজ্ঞতা তারা পেতেন। ভয় ও অপমানের চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে দিত গুম, যেখানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার স্বাভাবিক কাজও ছিল ব্যাপক যন্ত্রণার।”
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপনীয়তার বালাই না থাকায় সেলের ভেতরটা পুরুষ ভিকটিমের জন্য ছিল নিষ্ঠুরতার। ছোট ও বদ্ধ সেলে ছিল মলমূত্র ত্যাগের জন্য থাকত নিচু কমোড। থাকার জায়গার সঙ্গে কোনো দেয়াল থাকত না। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় কমোডে বসলেই শরীরের অংশ কমোডের বাইরে চলে যেত। এ কারণে নোংরা আর মলমূত্রের সঙ্গেই দিনাতিপাত করতে হত ভুক্তভোগীকে।
“সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার ছিল, সার্বক্ষণিক সবকিছু পর্যবেক্ষণে রাখা সিসিটিভি ক্যামেরা। ভুক্তভোগীকে অপমানের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে টয়লেট ব্যবহারের মতো ব্যক্তিগত সময়কেও নজরে রাখা হত।”
কমিশন বলছে, “নিচু একটু দেয়াল থাকায় নারী বন্দিদের অবস্থা ছিল পুরুষ বন্দিদের তুলনায় কিছুটা ভালো। সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি মধ্যে যদিও ওই খাটো দেয়াল গোপনীয়তা রক্ষার মতো পর্যাপ্ত ছিল না, দেখা যেত শরীরের উপরের অংশ। ব্যক্তিগত পরিসর বলতে কিছু ছিল না। ওড়না পরতে না দেওয়ার কথা বলেছেন ভুক্তভোগীরা।
চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে গুমের শিকার একজন ভুক্তভোগীর বরাতে কমিশন বলেছে, "ঘুমাতে নিলে, একজন আইসা বলতেছে, 'এই ঘুমাতেছেন কেন?' মানে ঘুমাইতে দিত না।... জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পরে বালিশ সরাই ফেলত। একদম শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলছে। আর এমনি শাস্তি দিত, চেয়ার ছাড়া [খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে] বসায় রাখত।
“... আবার দেখা গেছে, হ্যান্ডকাপ পরিয়ে বিছানার পাশে আটকে দিয়ে রাখত। তা আমার এই হাতে মশা বসলে আমি তো মারতে পারতাম না। মশা কামড়াইত।... তো কষ্ট পাইতাম আরকি। এরকম শাস্তি দিছে আরকি।"
আবার ভুক্তভোগীর শরীর বা তার অংশকে অনেকক্ষণ একই অবস্থানে রেখে দেওয়া হত, যন্ত্রণাকর অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে একজন ভুক্তভোগী কমিশনকে বলেছেন, "তো আলেপ উদ্দিন-পরে নাম জানতে পারছি, তখন জানতাম না-সে লাঠি নিয়ে খুব টর্চার করল। একদিন আমাকে বেশি টর্চার করল। টর্চার করে বলল যে, তাকে টাঙ্গায় রাখো, ঝুলায় রাখো।
“তো সেলে গ্রিল আছে না? রডগুলা যে আছে [ওগুলার সাথে] আমাকে এমনে ঝুলায় রাখল।... হাতকড়ার সঙ্গে বাইন্ধা রাখল। এইভাবে অনেক ঘণ্টা রাখার পরে আমি আর পারছি না। ওইদিন পরে যখন টর্চার করল, আঙ্গুলের নখটা উঠে গেছিল পুরা।"
মারধর হত সর্বত্র, নানান কায়দায়
দেশজুড়ে গুমের যত স্থান আছে, সবখানে পিটিয়ে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ পাওয়ার কথা বলেছে গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশন। তবে কোন কায়দায় পেটানো হত, সেটার ভিন্নতা পাওয়ার কথাও বলা হয়েছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।
গুম কমিশন বলেছে, মারধর ছিল সর্বব্যাপী এটা রূপ এবং এটা সবার সঙ্গেই ঘটেছে। এমনকি ভুক্তভোগী যাদের ওপর অন্য নির্যাতন হয়নি, তারাও এর শিকার হয়েছেন। তবে সাধারণত অন্যান্য নির্যাতন পদ্ধতির সঙ্গে মারধরও যুক্ত হত।
২০১৭ সালে র্যাবের হাতে ১১৩ দিন গুম থাকা একজন ভুক্তভোগীর জবানিতে আরেক দিনের মারধরের বর্ণনায় গুম কমিশন লিখেছে, “এর মধ্যে একদিন এনে আঙ্গুলটাকে এভাবে প্লাস দিয়ে ধরছে। ধরার পরে টেবিলের উপরে হাত রেখে, প্লাস ধরে, আরেকজন সুঁচ ঢুকাইছে। এই যে সুইয়ের দাগ। কয়, ‘তুই আব্দুল মুমিন না?’ ‘স্যার, আমি আব্দুল মুমিন না, আমার নাম হল হাবিব’।”
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে আরেকজন ভুক্তভোগী মারধরের বর্ণনা দিয়ে বলেন, “আমার পা বেঁধে উপর দিকে করে ঝুলাইছে। মাথা নিচের দিক, পা উপর দিক দিয়ে। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন, একেবারে উইদাউট ড্রেস।
“তারপরে এলোপাথাড়ি আমাকে দুইজনে একসঙ্গে পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে, চোখে বেঁধে রাখা কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো। ... শুধু পিছে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে গেছে।”
২০১৭ সালের র্যাবের হাতে ৭২ দিন গুম থাকা ওই ব্যক্তি আরও বলেন, “পরে যখন আমাকে একটা সেলের সংকীর্ণ একটা জায়গায় রাখে, তখন আমি পেছনে হাত দিয়ে দেখি যে রক্ত পড়তেছে। আর এটার দাগ প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত ছিল। মানে পেটানোর দাগ এরকম পুরো হয়ে গেছিল। ...
“তা আমি যখন উপর হয়ে শুয়ে আছি, তখন ওইখানে সাইফুল নামের একটা লোক, সে বলে যে, ‘ভাই, আপনি উপর হয়ে শুয়ে আছেন কেন?’ আমি বলছি, ‘ভাই, আমি বসে থাকতে পারতেছি না।’... আমাকে গায়ে হাত দিয়ে টর্চার করেছে ২৫ দিন।”
২০২৩ সালে পুলিশের বিশেস ইউনিট সিটিটিসির হাতে ১৬ দিন বন্দি থাকা আরেকজন ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেন, “চোখ কখনো গামছা দিয়া, কখনো ওই যে জম টুপি, এগুলা দিয়ে বাঁধা থাকত। হাত কখনো সামনে, কখনো পিছনে। আর যখন বেশি মারবে, তখন এই হাত পিছনে দিয়ে রাখতো আর আমার এই কনুইগুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে খুব জোরে জোরে মারতো, মোটা লাঠি দিয়ে…
“তো আমি মনে করতাম যে, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু পরে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু হাড় ভাঙছে এরকম বুঝি নাই।... এক পর্যায়ে আমাকে বলল যে, "তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলব।”
তিনি কমিশনকে আরও বলেন, “তখন আমার এই কনুইয়ের এই মাংসগুলো এভাবে ঝুইলা রইছে। এই যে জামার মোটা হাতা, এটা টাইট হয়ে গেছিল, এই পরিমাণ ফুলে ঝুইলা গেছে। এবং বলতেছে যে, ’তোর হাত থেকে মাংস আলাদা করে ফেলবো।’... তো এরপরে দীর্ঘদিন বসে নামাজ পড়াও কষ্টকর ছিল।...
“বলতেছে, ‘এভাবে হবে না। এরে লটকা। টানাইতে হবে।’ তো একজন এএসআই লোক হবে, ও আমাকে দুই হাতে রশি লাগায়া ওই যে ফ্যানের হুক থাকে ছাদের মধ্যে, এটার মধ্যে ওর রশি দিয়ে এরকম ঝুলাইল। শুধু পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে আর পুরা শরীরটা ঝুলানো। হাত এখনও ওঠাতে পারি না, আমার এটা দুইটা জোড়ার মধ্যে সমস্যা হয়ে গেছে।”
বৈদ্যুতিক শক
গুম কমিশন বলছে, মারধর সবাইকে করা হত। এরপর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নির্যাতনের উপায় ছিল বৈদ্যুতিক শক। এই ধরনের যন্ত্র সংগ্রহ করা সহজ হওয়ার কারণে এমনটা হতে পারে বলে ধারণা করছেন ভুক্তভোগী অনেকে।
“এগুলো প্রায় সর্বত্রই ব্যবহৃত হত, এমনকি অপহরণের কাজে ব্যবহৃত গাড়ির ভেতরেও এর ব্যবহার হত। একজন সৈনিক বলেছেন, তার কমান্ডার এটাকে ‘বল মেশিন’ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। কোথায় শক দেওয়া হবে, তা খুব নির্দয়ভাবে ইঙ্গিত করছিলেন তিনি।”
কীভাবে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হত, তা কয়েকজন গুমের শিকার ব্যক্তির বর্ণনায় তুলে ধরেছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
২০১০ সালে র্যাবের হাতে ৪৬ দিন গুম থাকা এক ভুক্তভোগী তার উপর চলা নির্মম নির্যাতনের বর্ণনায় কমিশনকে বলেছেন, “আমার শরীরে হাফ হাতা গেঞ্জি ছিল, কলারওয়ালা। সেটা মাথার উপর দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দেয়। দিয়ে মুখের উপর অনবরত হাত দিয়ে ঘুষি মারছিল, দাঁত দিয়ে ওপরের ঠোঁটটা আমার কেটে গেছিল। তাৎক্ষণিক পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগায় দিল...
“ফার্স্ট সেবার শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা। মনে হচ্ছে যখন শক দেয়, টোটাল শরীরটা আমার ফুটবলের মত গোল হয়ে যায়। এরকম আট দশবার মেবি আমাকে শক দিছে। শকটা হয়তো তিন-চার সেকেন্ড সর্বোচ্চ থাকে। তাৎক্ষণিক শরীরটা গোল হয়ে যায়, সমস্ত রগগুলো চেপে ধরে।”
এর মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ, শক দেওয়া এবং মারধর একসঙ্গে চলার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “খুবই বেপরোয়াভাবে চার-পাঁচ জন পিটুনি শুরু করল, দুই হাত ধরে ওই হুকের উপর লাগায় দিয়ে। মনে হচ্ছে হয়তো কিছুতে সুইচ টিপছে, অটোমেটিক আমার শরীরটা উপরে উঠে যাচ্ছে...
“এই মুহূর্তে আমার কাপড় খুলে, আবার ওই একই ক্লিপ লাগায় দেয় আমার গোপন দুইটা অঙ্গে। এবং ওই জিজ্ঞাসাবাদ সেম চলতে থাকে। যখনই সুইচ দেয়, আমার মনে হয়েছে যে, আমার সে অঙ্গগুলো পুড়ে যাচ্ছে... এবং মাঝে মাঝে আমি মাংস পুড়লে যেরকম একটা গন্ধ লাগে, সেই গন্ধটা পাইতাম আর কি।”
ওই বন্দি বলেন, “চার থেকে পাঁচজন টোটাল বডিতে, আমার পা থেকে একেবারে গলা পর্যন্ত পিটাত। গরু পিটানের মত, সবদিক দিয়ে। মানে, কোন জায়গাতে আমার ফাঁকা ছিল না। আমি জেলখানাতে যাওয়ার পরে শরীরটা যখন দেখি, মানে এমন কোন জায়গা ছিল না, সব কালো হয়ে গেছিল।”
গাড়ির ভেতরে বৈদ্যুতিক শকে নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা ২০১৪ সালে ডিজিএফআই এবং গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ৪৫ দিন গুম থাকা এক ভুক্তভোগীর বর্ণনায় তুলে ধরেছে গুম কমিশন।
৩২ বছর বয়সি ওই ব্যক্তি বলেন, “আমারে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির ভিতরে বসাইয়া চোখ বেঁধে ফেলল। হ্যান্ডকাফ পরাইয়া গালের মধ্যে জোরে একটা থাপ্পড় মারলো। মাইরা সিটের মধ্যে এরকম ফালাইয়া এনে রিভালভারে ধরে বলে, ’একটা কথা কবি তো তোরে মাইরা বুড়িগঙ্গা নদীতে ফালাইয়া দিমু’।
“হাতের এখানে একটা ক্লিপের মত লাগাইয়া কোথায় জানি একটা সুইচ টিপে দিল। মনে হলো আমার মাথায় একটা ঠাডা পড়ল। তারপরে আমি আর জানি না। যখন জ্ঞান ফিরছে, রাত্রি বাজে প্রায় ১টার মতো।”
২০১৭ সালে র্যাবের হাতে ১৩১ দিন গুম থাকা আরেকজন ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেছেন, “আমাকে ওই হাঁটুতে, তারপর পায়ের তালুতে খুব পিটাইলো। আমি খুব কান্নাকাটি করতেছি। আল্লাহর নাম নিলে আরো বেশি মারে। তো যাই হোক, এরপরে আমারে মারার পরে জিজ্ঞেস করতেছে, ‘কি জন্য নিয়ে আসছি? তুই কি বলতে পারোস?’ আমি বলতেছি যে, ‘না। কিজন্য নিয়ে আসছেন, এগুলো তো কিছু বললেন না। কোনো ধরনের কথাবার্তা ছাড়া আমাকে শাস্তি দিতেছেন। আপনারা কে বা কারা?’
“তখন তাদের আর পরিচয় দিল না, বলল যে, ‘তুই অমুককে চিনিস, তমুককে চিনিস?’ এই ধরনের কথা বলছে, যাদের সাথে আমার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নাই।”
যখনই জিজ্ঞাসাবাদকারীরা সামনে আসত, তখন কাঁপতে থাকার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “আরেকদিন রিমান্ডে নিয়ে গেল, রাত্রে ১২টা বাজে। ওই সময় ইলেকট্রিক শক দিল। কানের মধ্যে দুইটা ক্লিপ দিয়ে ইলেকট্রিক শক দিতে থাকলো।
“তারপর আমাকে বলল যে, ‘তোকে তো অনেক পিটাইলাম, মারলাম। কিন্তু তুই তো কিছু বললি না। অমুকরে তো তুই ভালো করেই চিনিস। তাহলে অমুকে তোকে এই সমস্ত কাজে আনছে।’”
একসঙ্গে, মুখে বাঁধা ভেজা কাপড়ে পানি ঢালা এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার বর্ণনা দিয়ে ওই ভুক্তভোগী বলেন, “আর ওই মুখের মধ্যে ভিজা কাপড় দিয়ে প্রায় দুই তিন মিনিটের মত পানি ঢালতো। ওই সময় দেখা যায়, আমি প্রায় সময়ই অজ্ঞান হয়ে যেতাম, আর মুখ দিয়ে খুব লোল-টোল ইত্যাদি পড়ত।
“তারা বলতেছিল যে, ‘তুই তো অনেক মেধাবী, তোর মেধাটা কিছু কমাই দিই।’ তো কানের মধ্যে ক্লিপ লাগায়া অনেকবার শক দিতো। এইভাবে মেধা কমানোর জন্য আমাকে কয়েকবার শক দিত, আর যখন শক দিত, পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যেত। সাথে সাথেই মনে হইতো যেন আমি শেষ। আমি চোখে ঝাপসা দেখতাম। এইভাবে আর কি, দিনের পর দিন শাস্তি দিত।”
ওয়াটারবোর্ডিং
বৈদ্যুতিক শকের মত সাধারণ ঘটনা না হলেও বিভিন্ন আটককেন্দ্রে ওয়াটারবোর্ডিংয়ে নির্যাতনের বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে ২০১৭ সালে র্যাবের হাতে ৩৯ দিন বন্দি এক ভুক্তভোগীর বরাতে বলা হয়েছে, “শোয়ানোর পরে আমার এই দুহাতের উপরে দিয়া আর ঘাড়ের নিচে দিয়া একটা বাঁশ দিছে। তার পরবর্তীতে পায়ের নিচে, রানের নিচে দিয়ে একটা দিল, আবার রানের উপরে দিয়েও একটা দিছে।
“দেওয়ার পরে এরা ওইভাবে আমাকে কিছুক্ষণ রাখলো যে, ‘বড় স্যার আসতেছে না।’ পরে কিছুক্ষণ পরে সে আসছে। আসার পরে হঠাৎ করেই বললো, ‘এই উঠো।’ বলার সাথে সাথে আমি মনে করলাম যে, আমি আর দুনিয়ার মধ্যে নাই। মানে এরকমের যন্ত্রণা আমার এই দুই হাতের বাহুতে শুরু হইছে, আর দুই পায়ের মধ্যে শুরু হইছে। আমার মনে হইতেছে কেউ আমার এই দুই হাতের আর পায়ের গোস্তগুলো ছিড়া ফেলতেছে। মানে এরকম অবস্থা।”
এমন নির্মম পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “এত খারাপ, ভয়ংকর এরা আমার সাথে ছিল। আমি চিৎকার করতেছি এত জোরে। ... এত কষ্টকর ছিল এই জিনিসটা।...
“আমার এই ডান হাত, বাম হাত এগুলো অবশ হয়ে গেছে, সম্পূর্ণ ডান হাতটা একেবারে এরকম মুঠ হয়ে গেছে। আমার যে হাতটা সাথে আছে, এটা আমি বলতে পারতাম না। এই হাত দিয়ে আমি কোন ভাতও খাইতে পারতাম না।... আমি শুধু তিন আঙ্গুল দিয়া যতটুক ভাত নিয়া খাইতে পারতাম, ওইটা খাইতাম। ... মুখের উপরে গামছা দিয়া উপরে দিয়া পানি মারা শুরু করে দিছে। ... পানি দিতেছে, জগ ভরতি ... আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাইতেছে।...”
এরপরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ২৭ বছর বয়সি ওই ব্যক্তি বলেন, “তারপর ওরা ওই গামছা সরাইয়া বলে, ’বল কি করছিস?’ ‘স্যার, কি কমু? আপনি আমারে বলেন, আমার কী জানতে চান? আপনি আমারে কেন ধইরা আনছেন?’ তখন বলতেছে, ‘না, ওরে হইতো না। আবার গামছা দে, আবার গামছা দে, আবার পানি দে।’ এইভাবে তিন-চারবার পানি দেওয়ার পরে বলছে, ‘ওরে নিয়া রাইখা আয়’।”
তীব্রবেগে ঘোরানোর যন্ত্র
দুই ধরনের তীব্রবেগে ঘোরানোর যন্ত্রে নির্যাতনের ঘটনা পাওয়ার কথা ভুক্তভোগীদের বরাতে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলেছে গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণত, র্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল এবং বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে ‘রোটেটিং’ (ঘুর্ণায়মান) চেয়ার ব্যবহার করা হত। ভুক্তভোগীকে চেয়ারে বসিয়ে মোটরের সাহায্যে এমন তীব্রবেগে ঘোরানো হত যে, ভুক্তভোগী বমি, প্রস্রাব ও পায়খানা করে দিত এবং অজ্ঞান হয়ে যেত।
ভুক্তভোগীদের ত্যাগ করা মলমুত্র পরিস্কারের সুবিধার্থে ওই চেয়ারের উপর প্লাস্টিকের শিট রাখার কথাও বলেছেন কমিশনকে র্যাবের এক সদস্য।
ডিজিএফআইয়ের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) দ্বিতীয় আরেক ধরনের বিশেষ রোটেটিং যন্ত্র পাওয়ার কথা বলেছে গুম কমিশন। সেই যন্ত্রের মধ্যে ভুক্তভোগীকে বেঁধে দেওয়া হত এবং সেটি প্রায় ৩৬০ ডিগ্রিতে, অর্থাৎ চতুর্দিকে ঘুরতে পারে।
ডিজিএফআই ও র্যাবের হাতে ১ বছর ১ মাস বন্দি থাকা একজনের বরাতে গুম কমিশন প্রতিবেদনে লিখেছে, “যখন জিজ্ঞাসাবাদ করত, তখন তো চোখ বাঁধা থাকত তিনটা কাপড় দিয়ে। প্রথমে একটা কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধত। জমটুপি পড়ানোর পরে আবার আরেকটা কাপড় দিয়ে বাঁধত। আর হ্যান্ডকাফ পিছনে লাগানো থাকত। ...
“চেয়ারটাতে বেঁধে, আমার দুই হাঁটু পিটাইয়া একবারে ফাটায় ফেলে। প্রায় ১০-১৫ দিন আমি সোজা হয়ে হাঁটতে পারতাম না। হাঁটার তো সুযোগ ছিল না। দাঁড়াইয়া যে নামাজ পড়বো, সেটাও সুযোগ ছিল না। পা ঝুলাইয়া, মানে ভিন্ন পাশে পা ঝুলাইয়া দিয়ে তারপর নামাজ পড়তে হত।... স্বাভাবিক একটা চেয়ার।
”ওই হুইল চেয়ারের মত যেমন পা রাখা যায়, ওরকম পা দানি আছে। পা দানির উপরে পা রাখার পরে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত অনেকগুলো বেল্ট লাগায়। মাথায় লাগায়, তারপরে বুকে, হাতের এদিকেও লাগায়। দুই সাইডে হাতে লাগায় তিনটা, বুকে লাগায় দুইটা, পেটে একটা, বুকে একটা বড় বেল্ট, মাথা, পায়ে এরকম তিনটা। এগুলোর পর আমাকে কিছুক্ষণ ঘোরানো হয়েছে। এইভাবে ওই চেয়ারে ঘোরানো হয়েছে।”
ওই ভুক্তভোগী আরও বলেন, “ওরা বলতেছে, ‘এখন তোকে ইলেকট্রিক শক দেব।’ আমাকে বলতেছে, ‘তোর গোপনাঙ্গে ইলেকট্রনিক শক দেব’, এরকম ভয় দেখাচ্ছে। আমি যখন বলতেছি, ‘আমি এদেরকে চিনি না, আমি কীভাবে বলব? তখন তারা দুইজনে দুইপাশ থেকে আমার হাঁটুতে মারতে থাকে।
“অনেকক্ষণ, মানে ওই টর্চারিংটা খুব বেশি ছিল। আমি যখন মানে একবারেই সহ্য করতে পারতেছিলাম, তখন তারা থামে। এভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করে প্রতিদিন তিন থেকে চারবার। অধিকাংশ দিন শেষ রাতে, মানে ফজরের আগে, এই সময়গুলোতে জিজ্ঞাসা করত। এখানে আনুমানিক সাড়ে সাত মাসের মত ছিলাম।”
প্রতিবেদনে ২০১৭ সালে ডিজিএফআই ও র্যাবের হাতে ২০৮ দিন বন্দি থাকা আরেক ভুক্তভোগীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, “একটা মেশিনে উঠাইছিল। উঠাই এইখানে [মাথায়] বাঁধছে, এইখানে [হাতে] বাঁধছে, পায়ে বাঁধছে, মানে হাঁটুর মিডলে, এইখানে আবার পায়ের নিচেও বাঁধছে। এরকম সোজা দাঁড়ানো। ওই মেশিনটায় তুলে চালিয়ে দেওয়ার পরে মনে হইছে যে, আমার হাড় সম্পূর্ণ যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
“কেন বলতে পারব না, ওটার সেটিং এরকম যে, মেশিনটাই একটা আজাব।... ওরা বলছে যে, ‘তুমি পিঠ একেবারে লাগাইয়া রাখ। এখানে উঠলে কিন্তু সব পায়খানা করে দেয়।’ মানে এমন কঠিন অবস্থা ওইখানে।... মেশিনটা ঘোরানো যায়। কখনো কখনো উল্টা করানো যায়। আবার এরকম ফ্ল্যাট শোয়ানো যায়। এরপর ওইখানে থাকা অবস্থায় হাঁটুর উপর বাড়ি দিছে। যেমন জিজ্ঞেস করছে, ‘তুমি সরকারের বিরুদ্ধে কী কী ষড়যন্ত্র করতেছ’?”
যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক
যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক, অন্ডকোষে জোরে চাপ দেওয়াসহ নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের উপায় নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ব্যবহার করার কথাও প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে গুম সংক্রান্ত কমিশন।
"এক পর্যায়ে তারা আমার মানে অন্ডকোষে জোরে চাপ দেয়, আমার শক্তি শেষ হয়ে যায়", এভাবে নিজের নির্যাতনের বর্ণনা গুম কমিশনকে দিয়েছেন ২০২০ সালে র্যাবের ১১ দিন গুম থাকা এক ব্যক্তি।
যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার বর্ণনায় একজন ভুক্তভোগীর বয়ানে গুম কমিশন বলেছে, “এক পর্যায়ে মারপিটের সাথে সাথে, আমার গোপন জায়গায় কারেন্ট শক দেয়।... বাথরুমে গেলে বলত যে, ‘চোখ একটা খুলবি, তারপরে কাজ সারবি।’ তো আমি আসলে ওখানে কাউকে ওভাবে দেখিও নাই।
“একদিন দুই-তিনজন ব্যক্তি ক্যামেরার সামনে নেয় এবং বলে, ‘আমরা যেভাবে বলি, ওইভাবে বলতে হবে, যেন কোনো ভুল না হয়।’ ল্যাপটপ সামনে ছিল, আর তাদের মুখ ঢাকা ছিল, আমি ওইভাবে তাদের ফেস দেখিও নাই। তো তারা সেখানে বলে যে, ‘তুই তোর জীবনের সবকিছু বল’।”
২০১৪ সালে র্যাবের কাছে ৩৪ দিন গুম থাকা আরেকজন গুম কমিশনকে বলেছেন, “চোখ বাঁধা, হ্যান্ডকাফ লাগানো।... এই যে এখনো দাগগুলো যায়নি, ১০-১১ বছর হয়ে গেছে। বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার সময়টা ছিল এরকম, যে আমাকে অন্ধের মতো একটা লাঠি ধরায় দিত। আমার হাত পেছনে বাঁধা এ অবস্থায় একটা লাঠি আমার হাতের ফাঁকার মধ্যে দিত।
“... উলঙ্গ করে কারেন্ট শক দিয়ে ঝুলায়ে রাখছিল দুই ঘণ্টার মতো। মানে একটাই দাবি যে আমাকে স্বীকার করতে হবে। ... এই বিষয়টা তো আমি মানতে রাজি হইনি। ... শকটা কীভাবে দিয়েছিল? পেনিসের মধ্যে ক্লিপ বা এই জাতীয় কিছু একটা লাগাইছিল আর হাত দুটো উপরে বাঁধা ছিল। এই অবস্থায় কারেন্ট শক দিত আর পিছন থেকে মারত। ‘হ্যাঁ’ বললে মার থামে, কারেন্ট শক থামে। ‘না’ বললেই মার চলে। ... মানে এগুলো অনেকটা সাজেশন টাইপের। বলতো যে, ‘তুমি এই সংগঠন করো?’ আমি বলছি, ‘না। শুরু হইলো কারেন্ট শক।”
২০১৬ সালে র্যাবের হাতে ৫৩ দিন বন্দি থাকা আরেক ভুক্তভোগী বলেন, “এমনকি আমার শরীরে কোনো কাপড় রাখেনি ওরা। আমাকে ঝুলাইছে। এরপরে কিছু কিছু টর্চার করছে, যেগুলো আমি আপনাকে বলতে পারতেছি না। যেগুলো বলা যায় না। আমার ওয়াইফ জানে। তো ওখানে আমি সেন্সলেস হয়ে যাই। তখন নামায় তারা আমাকে।...
“ছয় মাস দাগ ছিল আমার কব্জিতে। ওইখান থেকে আমার ঘাড়ের সমস্যা হয়ে গেছে, কারণ আমারে ঝুলায় রাখতে বলছে যে, আমি থাকতে পারতেছি না। ওরা নামায় নাই আমাকে। আমাকে টর্চার করছে এবং এমন জায়গায় ইলেকট্রিক শক দিছে, তারা বলতেছে, ‘তোকে আমি ইম্পোটেন্ট বানায় দিব, যদি তথ্য না দিস।’...
“আমাকে দীর্ঘসময় ইলেকট্রিক শক দিছে এবং আমি ফিল করতেছিলাম, ইচ অ্যান্ড এভরি পার্ট অব মাই বডি। মানে ইলেকট্রিক শক খেয়ে আমার মনে হচ্ছিল আমার পা এবং আমার মাথা দুইটা চাপ খেয়ে এক হয়ে গেছে। তো তারপরেও সবচেয়ে মজার ব্যাপার, তারা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। হ্যাঁ? তারা মনে হচ্ছিল মজা নিচ্ছিল।”
প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক
প্রস্রাব করার সময় যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার মত নির্মম নির্যাতনের বর্ণনাও ভুক্তভোগীদের বয়ানে তুলে ধরেছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
২০১৯ সালে র্যাবের হাতে ৬২ দিন বন্দি থাকা এক ভুক্তভোগী কমিশনকে বলেন, “তো এরা মারধর করলো, স্বীকার করানোর জন্য। বলছে যে, ‘তুই এটা স্বীকার কর, তাহলে তোর কপাল ভালো, না হলে কিন্তু তোর সমস্যা আছে।’ পরে আমি স্বীকার করলাম না।...
“অনেক পানি খাওয়ার পরে, পেশাব করতে দিছে। পেশাব করার সময় একটা বালতি দিছে। বালতির মধ্যে পানি ছিল। পানির মধ্যে যখন পেশাব পড়ে, তখন কারেন্টের শক লাগে।”
এরপর মারধর ও ঝুলিয়ে রাখার বর্ণনা দিয়ে ২৪ বছর বয়সি ওই ব্যক্তি বলেন, “মারধর করছে। বাইরাইছে। আর হ্যান্ডকাপটা খুইলা এখানে কী যেন একটা বাঁধলো। বাইন্ধা উপরে ঝোলাই থুইয়া দিছিল অনেকক্ষণ।... আর রাত্রে বেলা হাত পিছনে বাঁধা থাকলে ঘুমাইতে পারতাম না। পিছনে হাত বাঁধা থাকলে হাতগুলো অবশ হয়ে যেত।”
২০২২ সালে ৪৫ দিন গুম থাকা আরেক ভুক্তভোগী প্রস্রাব করার সময় বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “একটা যে কঠিন শাস্তি দিছে, সে শাস্তিটা হইলো একটা অন্যরকম। আমার তো চোখ বাঁধা। আমারে ধইরা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ওইদিন, মারধর করার পরে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতেছে। তখন আমি বুঝি যে, আজকে আমার জীবন শেষ।
“জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে কইতেছে, ‘এখানে প্রস্রাব কর। এখন এখানে প্রস্রাব কর।’ প্রস্রাব করার সাথে সাথে আমি অনুমান করছি যে, আমি মনে হয় পাঁচ ফিট উপরে উঠছি, একটা ফাল দিয়া, ইলেকট্রিক শক সবচেয়ে বড় কোনো স্থানে।”
সমাজের 'ভদ্রলোকেরা' গুমে জড়িত: প্রধান উপদেষ্টা
গুমে প্রধান ভূমিকা ছিল র্যাবের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের: প্রেস সচিব
গুম: শেখ হাসিনা 'নির্দেশদাতা', প্রমাণ পাওয়ার দাবি কমিশনের
হাসিনাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ‘গুমের’ অভিযোগ বিএনপির সালাহউদ্দিনের