Published : 10 Jul 2025, 12:52 PM
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কথা এলেই চোখে ভেসে আসে শৃঙ্খলা, সভ্যতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার ছবি। কিন্তু ইতিহাসের একটু গভীরে তাকালেই দেখা যায়—এই সাম্রাজ্য নির্মিত হয়েছে এক অদ্ভুত সমন্বয়ের ওপর: একদিকে ছিল দুর্বল ও স্বার্থান্ধ অভিজাত শ্রেণি, অন্যদিকে ছিল রাষ্ট্র-সমর্থিত অপরাধী গোষ্ঠী। এদের হাত ধরে যে শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা শুধু বাহ্যিক নয়, মানুষের চেতনায়ও শাসনের ছাপ রেখে গেছে। এই শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রতীক ছিল এক দর্শন: প্যানোপটিকন বা সমদর্শন কারাগার।
সমদর্শন কারাগারের ধারণাটি প্রথম প্রস্তাব করেন ব্রিটিশ দার্শনিক জেরেমি বেনথাম (Jeremy Bentham)। তার মতে, একটি গোলাকার ভবনের কেন্দ্রে একটি নজরদারির টাওয়ার থাকবে, যেখান থেকে একজন প্রহরী চারপাশের সব কয়েদিকে দেখতে পারবে। কিন্তু কয়েদিরা জানবে না, কখন তাদের দেখা হচ্ছে আর কখন নয়। ফলে সবসময় নজরদারির ভয়ে তারা নিজেদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে। এই পদ্ধতিতে বাহ্যিক বলপ্রয়োগ ছাড়াই তৈরি হয় আত্ম-শৃঙ্খলা।
এই মনস্তাত্ত্বিক শাসনের নকশা পরে ছড়িয়ে পড়ে স্কুল, হাসপাতাল, কারখানা এমনকি ঔপনিবেশিক প্রশাসনেও। উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশরা একটি ‘দেখা হচ্ছে’ ধরনের সমাজ তৈরি করতে চেয়েছিল, যেখানে মানুষ নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে, কারণ তারা সবসময় মনে করবে—ওপরে কেউ নজর রাখছে।
এই ‘দেখা হচ্ছে’ অবস্থা শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বা প্রশাসনের সুবিধার জন্য নয়, বরং উপনিবেশিত জাতিগুলোর আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। স্কুলে ইংরেজি ভাষা শেখানো, ধর্মে খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেওয়া এবং ব্রিটিশ পোশাক-আচরণকে ‘সভ্যতার’ মানদণ্ড হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া—এসবই ছিল এই প্যানোপটিক শাসনের অংশ।
ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় ঔপনিবেশিক মনোভাব ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। সেখানে মুখস্থনির্ভরতা ছিল মূল নিয়ম। ছাত্রদের শেখানো হতো কী ভাবতে হবে, কীভাবে ভাবতে হয় তা নয়। বিজ্ঞান পড়ানো হতো আপ্তবাক্য হিসেবে, বিশ্লেষণ বা প্রশ্ন না করেই মেনে নিতে বলা হতো। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অশিস নন্দী (Ashis Nandy – আশিস নন্দী) তার বই ‘দ্য ইনটিমেট এনেমি’তে (The Intimate Enemy) উল্লেখ করেন, ব্রিটিশরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে উপনিবেশিত জনগণের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিতে, যাতে তারা মনে করে তারাই ‘কমজোরি’, আর ইংরেজরাই ‘তর্কাতীত সত্যের ধারক’।
এই ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি কেবল জ্ঞানের জগতে বিভাজন আনেনি, বরং চিন্তার স্বাধীনতাকেও সংকুচিত করেছে। ভারতীয় শিক্ষাবিদ গৌরী বিশ্বনাথন (Gauri Viswanathan) তার বই ‘মাস্কস অফ কনকোয়েস্ট’ (Masks of Conquest)-এ দেখিয়েছেন, কিভাবে ইংরেজি সাহিত্য শিক্ষা ছিল একটি রাজনৈতিক অস্ত্র, যার মাধ্যমে উপনিবেশিতদের মানসিক জগৎ আয়ত্তে আনা হতো। শিক্ষায় যুক্তি নয়, আনুগত্য ছিল লক্ষ্য।
এই অবস্থার মূল কারণ ছিল অভিজাত ব্রিটিশ শাসকদের নিজেদের সীমাবদ্ধতা। তারা নিজেরা উপনিবেশ শাসনের জন্য যথেষ্ট প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শাসনের ভার দিয়ে দেয়, যারা ব্যবসার নামে পুরো উপনিবেশকে রূপান্তর করে এক লাভজনক শোষণ যন্ত্রে। উদাহরণস্বরূপ, রবার্ট ক্লাইভ বাংলা দখল করে কেবল সামরিক জয় নয়, বরং একটি বেসরকারি শাসনের পদ্ধতি প্রবর্তন করেন যা দুর্নীতি, লুটপাট ও আত্ম-সংশোধনমূলক দমন নীতির মিশ্রণ।
ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল (William Dalrymple) তার ‘দ্য অ্যানার্ক ‘ (The Anarchy) বইতে এই শাসন ব্যবস্থাকে এক ‘ব্যবসা-চালিত সাম্রাজ্য’ হিসেবে দেখিয়েছেন। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল তার বইয়ে দেখিয়েছেন যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ছিল রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় পরিচালিত এক ধরণের লুণ্ঠন-পুঁজিবাদ (loot capitalism)। তিনি বলেন, কোম্পানি কেবল ব্যবসা করত না, বরং তারা যুদ্ধ চালাত, ট্যাক্স বসাত, আইন বানাত, এমনকি শাসকের মতো আচরণ করত। আর এসব কিছু করা হতো ব্রিটিশ সরকারের নীরব সম্মতি ও কখনো সরাসরি অনুমতিতে। ডালরিম্পলের মতে, রবার্ট ক্লাইভ এবং তার অনুসারীরা বাংলা দখলের পর স্থানীয় সম্পদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এমন এক শোষণব্যবস্থা চালু করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল মুনাফা—জনকল্যাণ নয়। কোম্পানির এই শাসনের ফলে একদিকে ব্রিটিশ অভিজাতরা ভাগ পেত মোটা লাভের, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের ওপর চাপত দুর্ভিক্ষ, কর এবং বৈষম্য। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ডালরিম্পল দেখাতে চান যে আধুনিক কর্পোরেট লোভের যে চেহারা আমরা আজ দেখি, তার গোড়া আসলে ব্রিটিশ উপনিবেশের মধ্যেই গাঁথা আছে।
শাসনের এই কাঠামো শুধু বাহ্যিক নয়, বরং মনোজগতে প্রতিষ্ঠা পায়। মিশেল ফুকো (Michel Foucault) তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ (Discipline and Punish) বইয়ে দেখিয়েছেন, কিভাবে প্যানোপটিক শাসন মানুষকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণে বাধ্য করে। ঔপনিবেশিক জনগণ নিজেরাই নিজেদের ব্রিটিশ শাসনের যোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করত, কারণ তারা সবসময়ই আত্মদোষবোধে ভুগত।
স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের মতো অপরাধীর উত্থান এই প্যানোপটিকন-ভিত্তিক শাসনের পূর্বসূরি। স্পেনের জাহাজ লুট করে সোনা এনে তিনি রানি এলিজাবেথের পৃষ্ঠপোষকতা পান এবং নাইট উপাধি লাভ করেন। এখানে স্পষ্ট যে, অপরাধ রাষ্ট্র দিয়ে গৌরবান্বিত হচ্ছে। অভিজাত শ্রেণি নিজেরা ঝুঁকি না নিয়ে অপরাধীদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয় এবং ফলে অপরাধই হয়ে ওঠে শাসনের কাঠামো।
ঔপনিবেশিক শাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল শ্রেণি ও জাতিগত বিভাজন। ইংরেজরা সবসময় চেষ্টা করত শাসক ও শাসিতের মাঝে একটি অদৃশ্য দেয়াল রাখতে। অফিসে, আদালতে, রেলস্টেশনে—যেখানে-সেখানে ইংরেজদের জন্য ছিল আলাদা জায়গা এবং স্থানীয়দের জন্য ছিল ভিন্ন। এই বিভাজন কেবল বাহ্যিক ছিল না, বরং তা ছিল গভীরভাবে মনোজাগতিক। স্থানীয়রা মনে করত, তারা 'কম উন্নত', 'কম যোগ্য'—এবং এই ভাবনাই ধীরে ধীরে তাদের চেতনার অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
এই মনোভাব তৈরি করতে শিক্ষার মাধ্যমেই শাসনের সবচেয়ে সূক্ষ্ম পদ্ধতিগুলো চালু করা হয়। উপনিবেশ বিষয়ক বিশ্লেষক হোমি কে. ভাভা (Homi K. Bhabha) তার ‘দ্য লোকেশন অব কালচার’ (‘The Location of Culture-১৯৯৪) বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসকরা একটি ‘মিমিক মেন’ শ্রেণি গড়ে তোলে—যারা শাসকের ভাষা, চালচলন ও চিন্তা নকল করেও কখনো আসল হতে পারে না। এর ফলে উপনিবেশিতরা সবসময় এক ধরনের সাংস্কৃতিক 'অপর্যাপ্ততা' অনুভব করে, যা প্যানোপটিক চেতনার সঙ্গে মিলে যায়। এই বিভাজনমূলক বাস্তবতা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের একটি সূক্ষ্ম কিন্তু শক্তিশালী অস্ত্র। কারণ এটি উপনিবেশিতদের শুধু বাহ্যিকভাবে নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টির স্তরেও শাসনের অধীন করে তোলে।
এই শাসনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রভাব হলো—এটি আজও আমাদের মনে ও সমাজে টিকে আছে। প্রশাসনে এখনও ওপরের ‘অদৃশ্য চোখে’ ভয় কাজ করে, শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও আত্মবিশ্বাস গড়ে না তুলে মুখস্থ ও আনুগত্য শেখায় এবং আমাদের অনেকেই মনে করি ‘বিদেশি মানেই ভালো’। সবচেয়ে বড় কথা, অর্থনৈতিক উন্নতির ইঁদুর দৌড়ে, যে চর্চাগুলো এই শৃঙ্খল ভাঙ্গতে সাহায্য করে–যেমন, হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষা অপ্রতুল হয়ে থাকে নানা অজুহাতে। আমরা, বাংলা মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা যেমন প্রথম বিজ্ঞান ল্যাব করতাম ক্লাস নাইন বা টেনে এসে। অথচ বিজ্ঞানের সূচনা প্রাকৃতিক জগতকে গভীরভাবে দেখার মধ্য দিয়ে। এই চর্চাটায় দামি যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আমরা বাংলার বুকে পুরো স্কুল জীবন কাটিয়ে দিয়েছি পরীক্ষা আর নম্বরের চক্করে। এইসবই প্যানোপটিক চিন্তার উত্তরাধিকার।
আজ আমরা স্বাধীন, কিন্তু প্যানোপটিক শাসনের সেই ‘অদৃশ্য কারাগার’ থেকে কি আমরা আদৌ মুক্ত?
আমার বিশ্বাস, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল শুধু অভিজাতদের একক পরিকল্পনায় নয়, বরং ইউরোপীয় অভিজাত শ্রেণির নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে ঔপনিবেশিক জাতি ও শ্রেণিগুলোর নানা রকম পারস্পরিক দেন-দরবার, সমঝোতা এবং সংস্কৃতিগত হাইব্রিডাইজেশনের (hybridization) এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এই সাম্রাজ্যের সবচেয়ে টেকসই অস্ত্র ছিল না কেবল বন্দুক বা সরাসরি রাজনৈতিক দমন, বরং ছিল একটি অদৃশ্য চক্ষু—যা প্যানোপটিকন (Panopticon) দর্শনের মতো করে মানুষকে বাহ্যিক নয়, বরং চেতনার ভেতর থেকে শাসন করত। এই মনস্তাত্ত্বিক শাসনই ঔপনিবেশিক কাঠামোর সবচেয়ে গভীর ছাপ রেখে গেছে আমাদের সমাজে, শিক্ষা ও আত্মপরিচয়ের ভেতরে।