Published : 10 Jul 2025, 07:05 PM
বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যায়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাকে শুধু একটি পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবেই গণ্য করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়, কর্মজীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে। কিন্তু এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে গভীর উদ্বেগ ও হতাশার এক চিত্র ফুটে ওঠে—যা কেবল সংখ্যাতাত্ত্বিক নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি।
২০২৫ সালের এই পরীক্ষায় গড় পাসের হার মাত্র ৬৮.৪৫ শতাংশ। এটি গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ১৪.৫৯ শতাংশ কম। এ বছরের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মোট ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ জন শিক্ষার্থী, যার মধ্যে মাত্র ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন পাস করেছে। অর্থাৎ, প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এক কথায়, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী কোনোভাবে উত্তীর্ণ হতে পারেনি—এটা নিঃসন্দেহে এক জাতীয় বিপর্যয়।
এই বিপুল সংখ্যক অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর মধ্যে বেশিরভাগই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাদের অনেকের শিক্ষাজীবন এখানেই থেমে যেতে পারে। কেউ কেউ আর কখনো শ্রেণিকক্ষে ফিরে না-ও আসতে পারে। এর ফলে শুধু তাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ নয়, পুরো জাতির ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কেননা, একটি দেশের মানবসম্পদ তার সবচেয়ে বড় সম্পদ এবং শিক্ষা তার ভিত্তি।
শুধু পাসের হার নয়, পূর্ণাঙ্গ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। গত বছর যেখানে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল, এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জনে। অর্থাৎ, ৪৩ হাজার ৯৭ জন শিক্ষার্থী কম জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর পেছনে বহু কারণ বিদ্যমান—শিক্ষার মান, পরীক্ষা পদ্ধতি, পাঠ্যক্রমের অসঙ্গতি, শিক্ষক ঘাটতি, মনোবৈজ্ঞানিক সহায়তার অভাব এবং সর্বোপরি নীতিনির্ধারকদের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এবারের পরীক্ষায় ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৫১টি। এ ধরনের পরিসংখ্যান আমাদের কাছে শুধু অস্বস্তিকর নয়, লজ্জাজনকও বটে। শিক্ষকের অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং তদারকির অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যত শিক্ষাদান-অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান এখনও সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে চলে যাচ্ছে, যা দুর্নীতির ছায়াও উন্মোচন করে।
করোনা মহামারির পরে শিক্ষার্থীদের শিখনগত ঘাটতি পূরণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শিক্ষাবিদরা বারবার পরামর্শ দিয়েছেন বাড়তি ক্লাস, মানোন্নয়ন কর্মশালা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং শিক্ষাপঞ্জি পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশই কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। নোটবই, গাইডবই এবং কোচিং নির্ভরতা বাড়ছে—যা মূল পাঠ্যবই ও শিক্ষকের ওপর শিক্ষার্থীর নির্ভরতা কমিয়ে দিচ্ছে। এতে করে প্রকৃত শিখনের চেয়ে মুখস্থ বিদ্যার প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার সঙ্গে বিদ্যার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, এবারের পরীক্ষার সময়সূচি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রায় দুই মাস পিছিয়ে ১০ এপ্রিল শুরু হয়। এ সময়সূচির অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, প্রস্তুতিতে অনিশ্চয়তা এনেছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষা, উৎকণ্ঠা ও দ্বিধা তাদের মানসিক চাপ বাড়িয়েছে—যা ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলেই অনেকেই মনে করেন।
এখানে একটি গভীর সামাজিক মনোভাবের কথাও উল্লেখ করতে হয়—অকৃতকার্য হওয়া মানেই ব্যর্থতা, আর ব্যর্থ মানেই ‘অযোগ্য’ বা ‘নিছক অদক্ষ’। এই সংকীর্ণ ও অবিবেচিত দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বদলাতে হবে। একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় পাস করতে না পারলেও, সেটি কেবল তার দোষে হয়েছে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। এটি পুরো ব্যবস্থারই ব্যর্থতা। মনে রাখতে হবে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জগদীশচন্দ্র বসুর মতো মনীষারাও শিক্ষাজীবনের শুরুতে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেননি। কিন্তু তারা ছিলেন মেধাবী, একাগ্র ও মননশীল। তাই ফলাফল নয়, শেখার প্রকৃত অর্থ বোঝাটাই জরুরি।
এসএসসি পাস করলেই একজন শিক্ষার্থী শিক্ষিত হয়ে যায় না। প্রমথ চৌধুরীর সেই কালজয়ী উক্তি এখানে স্মরণীয়—“পাস করা ও শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয়।” কেবল ভালো ফলাফল, জিপিএ-৫ পাওয়া কিংবা উচ্চ নম্বর অর্জন করাই শিক্ষা নয়, যদি সেই শিক্ষা জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, সমাজে মূল্যবোধ তৈরি না করে, আত্মিক উন্নয়নে ভূমিকা না রাখে।
প্রতিটি শিক্ষার্থী যদি শুধু ভালো রেজাল্টের পেছনে না ছুটে, বরং সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার প্রতি তার দায়িত্ববোধকে অনুভব করে—তবে সেটিই হবে প্রকৃত শিক্ষার সফলতা। একজন মানুষ কতটা নম্বর পেয়েছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—সে শিক্ষা গ্রহণ করে কীভাবে তা নিজের এবং সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করছে। একজন ডাক্তার যদি সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে মেডিকেল কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হয়, অথচ গ্রামের অসহায় মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তাদের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করে, তবে তার সেই জিপিএ-৫ কেবল একটি সার্টিফিকেট, সেটি মানবিকতার কোনো মানদণ্ড নয়। আর যদি কোনো মাঝারি ফল করা চিকিৎসক মানবিকতা, নিষ্ঠা এবং দায়িত্ববোধ নিয়ে রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকেন, তবে তিনিই প্রকৃত শিক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেন।
আমাদের সমাজে এখনো ‘ফলাফল’কে শিক্ষার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ প্রকৃত শিক্ষা তখনই গঠিত হয়, যখন একটি মানুষ তার জ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষের পাশে দাঁড়ায়, দেশ গঠনে ভূমিকা রাখে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং নিজেকে একজন সদ্ব্যবহারকারী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। কেবল তথ্যভিত্তিক শিক্ষা বা পরীক্ষায় ভালো ফল শিক্ষিত মানুষ তৈরি করে না; বরং নৈতিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি, সহনশীলতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার চর্চা একটি মানুষকে পরিপূর্ণ শিক্ষিত করে তোলে। শিক্ষা তখনই অর্থবহ, যখন তা একজন মানুষকে শুধুই “স্মার্ট” নয়, বরং “সচেতন” এবং “সহানুভূতিশীল” করে তোলে।
শিক্ষার্থীদের আমরা যদি কেবল মার্কশীটের দিকে তাকিয়ে মূল্যায়ন করি, তবে অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা হারিয়ে যাবে। যারা এই বছর উত্তীর্ণ হয়েছে, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য রইল আন্তরিক শুভকামনা ও অভিনন্দন। তারা অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্যের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। কিন্তু আমরা ভুলে গেলে চলবে না, তারা কেবল নিজেদের জন্য নয়, জাতির জন্যও এক সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। তাদের কাঁধে এখন শুধু সার্টিফিকেটের গৌরব নয়, বরং বাংলাদেশকে একটি সুশিক্ষিত, মানবিক এবং উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তর করার গুরুদায়িত্বও এসে পড়েছে।
অন্যদিকে, যারা এবারের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো এখন শুধু সহানুভূতির বিষয় নয়—এটি আমাদের সামাজিক ও নৈতিক কর্তব্য। ব্যর্থতা কোনো অপরাধ নয়; বরং পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর শক্তিই প্রকৃত মানুষকে গড়ে তোলে। এই শিক্ষার্থীদের হীনম্মন্যতায় না ঠেলে, আমাদের উচিত তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, তাদের পাশে থেকে প্রমাণ করে দেয়া—তারা একা নয়। তাদের সাফল্যও একদিন আসবে, যদি আমরা সকলে মিলেই তাদের নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ করে দিই।
শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজ এবং রাষ্ট্র—এই চারটি স্তম্ভের সম্মিলিত সহায়তা ছাড়া শিক্ষা-ব্যবস্থার পূর্ণতা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, অভিভাবকতা মানেই কেবল সফল সন্তানের ছবিতে গর্বিত হওয়া নয়; বরং যখন সন্তান হোঁচট খায়, ব্যর্থ হয়, হতাশ হয়—ঠিক তখনই তার পাশে থাকা, তাকে আগলে রাখা, তাকে নতুন করে পথ দেখানোই হলো প্রকৃত অভিভাবকত্বের আসল পরিচয়। প্রতিটি ব্যর্থতা যদি উৎসাহ ও সহানুভূতির মাধ্যমে শক্তিতে পরিণত করা যায়, তবে একটি পুরো প্রজন্ম আলোকিত হতে বাধ্য।
যখন সমাজ ও রাষ্ট্র একসঙ্গে সফলতা ও ব্যর্থতা—উভয়কেই সহমর্মিতার চোখে দেখতে শিখবে, তখনই আমরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবো, যা কেবল সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থী নয়, বরং হৃদয়বান ও দায়িত্ববান মানুষ সৃষ্টি করবে। সেই শিক্ষাব্যবস্থা হবে আগুনের মতো—প্রমিথিউসের পবিত্র আগুনের মতো—যা আলো দেবে, উষ্ণতা দেবে, পথ দেখাবে, তবে কাউকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে না।
এই শিক্ষা যেন হোক আলোকিত ভবিষ্যতের হাতছানি, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী, সফল বা ব্যর্থ, নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সমান সুযোগ পায়। সেই দিনই হবে আমাদের জাতির জন্য সত্যিকারের বিজয়ের দিন। আমাদের চোখে-মুখে সেই আলোর দীপ্তি উদ্ভাসিত হোক—এটাই আজকের প্রত্যাশা।