Published : 10 Jul 2025, 11:53 AM
জাতীয় পার্টির দিনাজপুর জেলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ৮ জুলাই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তার এই পদত্যাগের সংবাদটি জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক কোনো সংবাদমাধ্যমেই তেমন গুরুত্ব পায়নি। অনেক খুঁজে কেবল জাগোনিউজে এ বিষয়ে একটি সংবাদের দেখা মিলেছে।
স্বাভাবিক, যখন দলের কেন্দ্রে চলছে ক্যু ও পাল্টা-ক্যুর নাটক, তখন প্রান্তিক এক জেলার সভাপতির পদত্যাগ সংবাদমূল্যের দিক থেকে গুরুত্ব হারাতে পারে। কিন্তু ঘটনাটির প্রতীকী তাৎপর্য উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কারণ, দেলোয়ার হোসেনের এই পদত্যাগ ইঙ্গিত করে যে, ‘জাতীয় পার্টির দুর্গ’ নামে পরিচিত উত্তরাঞ্চলেই ঝড়ের কবলে পড়তে শুরু করেছে দলটি। এই ঝড়ো হাওয়া যদি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তবে দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের দলের মহাসচিব মজিবুর রহমান চুন্নুসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে বহিষ্কার করেছেন। শোনা যাচ্ছে, ওই নেতারা নাকি খোদ চেয়ারম্যানকেই দল থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
তবু দিনাজপুরের সভাপতির পদত্যাগের খবরটিকে শুধু আঞ্চলিক ঘটনা হিসেবে দেখলে চলবে না; এতে রয়েছে একটি স্পষ্ট প্রতীকী মূল্য। গত বছর ৫ অগাস্ট পর্যন্ত তিনি ছিলেন দিনাজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
তৃণমূলের নেতারা হয়তো দেলোয়ার হোসেনের মতো খোলাখুলি পদত্যাগের ঘোষণা দেবেন না, কিন্তু নীরবে অনেকেই অন্য কোনো দলে চলে যাবেন। আর সেই অদৃশ্য স্রোতের মধ্য দিয়েই লাঙলের কফিনে ঠুকে যাবে শেষ পেরেক।
পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম আমি নিজেই—ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে ফোন করেছিলাম দেলোয়ার হোসেনকে। শুধু তার সঙ্গেই নয়, কথা বলেছি দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং আরেকজন সম্পাদকের সঙ্গেও।
দেলোয়ার হোসেনের দাবি, ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকেই তিনি দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় ছিলেন এবং তখন থেকেই পদত্যাগের কথা বলছিলেন। যদিও সে সময় আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি, এবার তা বাস্তবায়ন করলেন। উল্লেখ্য, তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন।
দলত্যাগের সিদ্ধান্ত আগে থেকে নেওয়া থাকলেও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো যে তাকে ক্ষুব্ধ করেছে, তা আলাপচারিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার ভাষায়, “এভাবে একটা দল চলতে পারে না। যে দল নিজের ঘরই সামলাতে পারে না, যার প্রায় তিন মাস পরপর ভেতরের কোন্দল বাইরে চলে আসে—সে দলে আর থাকা যায় না।”
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নির্দেশেই চলেছে। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদের নামে মামলা ছিল অনেক, তিনি দীর্ঘদিন কারাবন্দি থেকেছেন এবং সব সময় গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পরও দলটি সেই বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবেই থেকে গেছে।
দেলোয়ার হোসেন ভেবেছিলেন, জিএম কাদের দলটিকে শক্ত হাতে পরিচালনা করবেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো—ভেতরের কোন্দল বেড়েই চলেছে। এ কারণেই তিনি চূড়ান্তভাবে দল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জাতীয় পার্টির দিনাজপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আহমেদ শফি রুবেলের মতে, দলের ভেতরকার ফ্যাসিস্ট মনোভাবাপন্ন নেতাদের বহিষ্কার করে চেয়ারম্যান জিএম কাদের সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। নতুন মহাসচিবের ব্যাপারেও তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত।
তবে জেলা কমিটির আরেকজন সম্পাদককে মনে হলো স্পষ্টত হতাশ। জানালেন, তিনি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরপরই—ঠিক তখন, যখন ‘হালুয়া-রুটির’ ভাগ পাওয়ার কিছুই ছিল না। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছিলেন হতাশার সুরে, “আমরা আছিই কিছু মানুষ। তাদের মধ্যেই যদি একে-ওকে ঠেলে বের করে দেওয়া হয়, তাহলে দল চলবে কীভাবে?”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতীয় পার্টির আবির্ভাব কোনো গণআন্দোলনের ফসল নয়; বরং এটি সামরিক বাহিনী থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের এক অনিবার্য ধারাবাহিকতা।
১৯৮২ সালে সেনাবাহিনীপ্রধান হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তার আগে দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার—যিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিশ্বস্ত উত্তরসূরি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
এরশাদ তাকে সরাতে নানা ফন্দিফিকির করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ইমদু কাণ্ড’—যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবনে এক কুখ্যাত সন্ত্রাসীর উপস্থিতি দেখিয়ে রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত করার প্রচেষ্টা। এই ঘটনাকে মূল অজুহাত বানিয়ে আবদুস সাত্তারকে পদত্যাগে বাধ্য করেন এরশাদ এবং নিজের ক্ষমতার পথ পরিষ্কার করেন।
পরে ক্ষমতার বৈধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালে গঠন করেন জাতীয় পার্টি—যা ছিল মূলত বিএনপির একটি কপি-পেস্ট দল।
তবে জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপির মধ্যে সামরিক পটভূমিকে ঢেকে একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল এবং সেটা দলটি সাফল্যের সঙ্গেই করতে পেরেছে। যেখানে এরশাদের জাতীয় পার্টি মূলত প্রশাসনিক সুবিধা এবং স্বার্থের রাজনীতির একটি বাহন হিসেবে বিবেচিত হতো। ক্ষমতা হারানোর পরও এই দলটি কিছুদিন টিকে ছিল এরশাদের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, প্রশাসনিক সংযোগ এবং উত্তরাঞ্চলে তার প্রতিষ্ঠিত শক্ত ঘাঁটির ওপর ভিত্তি করে। বিশেষত নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দলটি মাত্র কিছুদিন পর অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সংসদে ৩৫টি আসন পেয়ে দেশবাসীকে চমকে দিয়েছিল।
কিন্তু দলের চরিত্র কখনোই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি। এরশাদের দুর্নীতি, বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে তার দোদুল্যমান অবস্থান এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে কখনো জোট, কখনো বিরোধিতা—এসব কারণে দলটি মূলধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
এরশাদের মৃত্যুর পর যখন তার ভাই জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হন, তখনই প্রশ্ন ওঠে: এই দল আদৌ সংগঠিত অবস্থানে থাকতে পারবে কি?
জি এম কাদেরও বাংলাদেশের উত্তরাধিকারের রাজনীতির আরেকটি উদাহরণ। তার সাংগঠনিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে শুরু থেকেই সংশয় ছিল। তিনি যতটা না একজন রাজনীতিবিদ, তার চেয়ে বেশি একজন প্রশাসকসুলভ নির্বাহী। যদিও তার হাতে অগাধ ক্ষমতা ছিল, সেই ক্ষমতা ব্যবহারে দূরদর্শিতা দেখাতে পারেননি বলে মনে হয়।
জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, চেয়ারম্যান চাইলে যে কাউকে বহিষ্কার করতে পারেন এবং সেটাই তিনি প্রয়োগ করেছেন। তবে ক্ষমতা থাকলেই যে সেটি প্রয়োগ করতে নেই, তা বুঝবার মতো দক্ষতা তার নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। দলের অভিজ্ঞ নেতাদের একে একে দমন করে তিনি তৈরি করছেন অনুগতদের সংকুচিত বলয়—যার প্রতীক হয়ে উঠেছেন নতুন মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী। রাজনীতির অঙ্গনে এই তরুণ নেতা যদিও মুখচেনা, কিন্তু মূলত আনুগত্যের বিনিময়ে পদ পেয়েছেন; মজিবুর রহমান চুন্নুর জায়গায় এসেছেন নেতৃত্বের বিচারে নয়, আনুগত্যের ভিত্তিতে—এমনটাই মনে করছেন অনেক বিজ্ঞজন।
মজিবুর রহমান চুন্নুর মতো একইভাবে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে দলীয় কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা এরই মধ্যে জিএম কাদেরের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে দলের ভেতরে আলাদা কাউন্সিল ডাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অর্থাৎ, এখন জাতীয় পার্টি আবারও ভাঙনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
জাতীয় পার্টির ইতিহাসে ভাঙন অবশ্য কোনো নতুন ঘটনা নয়। বরং বিভক্তি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক জোটবদ্ধতা এই দলের রাজনৈতিক চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশাতেই দলটি কয়েকবার ভেঙে বিভিন্ন ব্র্যাকেটে বন্দি হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় দল থেকে আলাদা হয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ‘জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)’ গঠন করেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হয়ে নির্বাচন করেন এবং পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে সাবেক মন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ দল ভেঙে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হয়ে ওঠে।
একই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ভাঙন ঘটান বরিশাল অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা, সাবেক মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুর। যিনি আবার শেখ পরিবারের আত্মীয় হলেও আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত হন। মঞ্জুরের তার ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ পরে এই দলের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেন।
সর্বশেষ দলটি ‘ব্র্যাকেট’ বন্দি হয়—গত বছর এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে। তবে দলের মূল অংশ তখনও জিএম কাদেরের নেতৃত্বের ছায়ায় রয়ে গিয়েছিল।
এই ধারাবাহিক ভাঙন শুধু ব্যক্তিস্বার্থ বা ক্ষমতার ভাগাভাগির ফল নয়—এটি দলটির আদর্শহীন, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্রেরও বহিঃপ্রকাশ। কখনও বিএনপি, কখনো আওয়ামী লীগ—যে দল যখন ক্ষমতায় গিয়েছে, তাদের কাছাকাছি থেকে সংসদে কিছু আসন নিশ্চিত করাই ছিল দলটির বিভিন্ন অংশের অঘোষিত কৌশল। ফলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্র থেকে বারবার ছিটকে পড়েছে আঞ্চলিক নেতারা, গড়ে উঠেছে বহু বিভক্ত দল, যাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল প্রায়শই পরস্পরবিরোধী। এরশাদ জীবিত থাকাকালীন বিভাজন সামলানোর মতো একক নেতৃত্ব থাকলেও, তার মৃত্যুর পর সেই ভারসাম্য বিন্দুটিও বিলীন হয়ে গেছে।
এবারের বিভক্তি আর অতীতের মতো নেই—এবার এটি মূল জাতীয় পার্টির পুরো কাঠামোকেই আঘাত করছে। নেতৃত্বে আস্থাহীনতা, সাংগঠনিক শূন্যতা এবং রাজনৈতিক দিকহীনতার কারণে দলটির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বারবার ভাঙনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি এখন এমন এক চূড়ান্ত দুর্বলতার মধ্যে পড়েছে, যেখানে তার কার্যকর রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
রাজনৈতিক দলের বিলীন হয়ে যাওয়ার ইতিহাস ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন পুরনো, বাংলার ক্ষেত্রেও এটি নতুন নয়। অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মুসলিম লীগের পতাকা ধরে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিলেও, পাকিস্তান আমলেই সেই দল পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে যেতে থাকে।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভিন্ন সময় নানা ব্র্যাকেটে বন্দি মুসলিম লীগ দেখা গেলেও, প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাপও এখন আর নেই। মুসলিম লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের হাতে গড়া আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পরে মুসলিম শব্দটি ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ গঠনের মূল কারিগর ছিলেন ভাসানী। সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার অনুসারীদের সঙ্গে দ্বিমতের কারণে নিজের হাতে গড়া এই আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসেন এবং গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে টিকে থাকা ন্যাপ মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নিজেদের বিলীন করে দেয় জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপিতে। মুসলিম লীগের মতো কখনও কখনও ন্যাপের কিছু কার্যক্রম দেখা গেলেও দলটির মৃত্যু ঘটেছে সত্তরের দশকে বিএনপি প্রতিষ্ঠার সময়ই।
জাতীয় পার্টির নাম ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওই দলগুলোর সঙ্গে উচ্চারিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি কিংবা ন্যাপ—সবগুলোই জনগণের দাবি-দাওয়া, অধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠেছিল। সেই দলগুলো আদর্শ ও জনসম্পৃক্ত রাজনীতির ধারক ছিল, যার কারণে তাদের বিলুপ্তি রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় বেদনার স্মৃতি হয়ে আছে।
উর্দিপরাদের ক্ষমতা দখলের বৈধতা দিতে গিয়ে কৃত্রিম রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে গড়া ওই ঐতিহাসিক দলগুলোর মর্যাদায় জাতীয় পার্টি কখনোই পৌঁছাতে পারেনি। সেই কারণেই দলটির সম্ভাব্য বিলুপ্তি নিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে বেদনা তো দূরের কথা, বরং নির্লিপ্ততাই বেশি দেখা যাচ্ছে।
এ ঘটনা ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ গড়ে উঠছে। দেড় দশক ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, নিরুত্তাপ বিরোধিতা এবং সাংবিধানিক শূন্যতার পটভূমিতে একের পর এক বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি উদ্ভব হচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, যারা ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলো সফর করেছে।
যেসব এলাকা আগে জাতীয় পার্টির ঐতিহ্যবাহী বলয় হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই এলাকাগুলোতেই এখন পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক ভিত্তি শুধু অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নয়, রাজনৈতিক প্রতিস্থাপনের মুখেও পড়েছে। এই প্রতিস্থাপন শুরু হয়ে গেছে এবং মাঠেও এর প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। যে উত্তরাঞ্চল একসময় জাতীয় পার্টিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেখান থেকেই তাদের বিলীন হওয়ার যাত্রা শুরু হতে পারে।