Published : 23 Jun 2024, 09:23 AM
মুঘল স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বড় শরীফুর মসজিদ। ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্মৃদ্ধ এই স্থাপনাটি দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
মসজিদটি ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার বাইশগাঁও ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামে ১৬৫৭ সালে দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। পৌনে ৪০০ বছরেও এটির সৌন্দর্য ‘নষ্ট হয়নি’। মুঘল আমলে নির্মিত চুন-সুরকির মসজিদটি দেখতে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমান। পাশাপাশি অনেকে নামাজও আদায় করেন।
বাইশগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন বলেন, “এটি একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। এ মসজিদের সৌন্দর্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। পৌনে ৪০০ বছর আগে এমন নান্দনিক মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। এতেই বোঝা যায় ওই সময় ওই অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল।”
বড় শরীফপুর মসজিদটির সীমানা মনোহরগঞ্জ উপজেলায় পড়লেও মূলত ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি তিন জেলার মোহনায় অবস্থিত। এর পাশেই চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা এবং দক্ষিণে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা। মসজিদ লাগোয়া স্থানে রয়েছে ৩৫ দশমিক ২৯ একর আয়তনের সুবিশাল নাটেশ্বর দিঘি। মূলত দিঘির পাড়েই মসজিদের অবস্থান।
স্থানীয়রা বলছেন, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ ও চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার বাসিন্দাদের যৌথভাবে বিশাল আকৃতির ওই দিঘিটির মালিকানা রয়েছে। এ ছাড়া ওই দিঘির পাড়ে রয়েছে হযরত সৈয়দ শাহ শরীফ বাগদাদী নামে এক ধর্মগুরুর মাজার। মসজিদ, দিঘি ও মাজারকে ঘিরে ওই স্থানটি পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
বড় শরীফুর মসজিদ পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেন, “মসজিদ লাগোয়া দিঘিটি আর মসজিদের স্থাপত্যকাল প্রায় একই সময়ের। নাটেশ্বর রাজা ওই দিঘিটি খনন করেন বলে জানা যায়। যার কারণে দিঘিটি তার নামানুসারেই নাটেশ্বর দিঘি নামে পরিচিত।
“বড় শরীফপুর মসজিদটি একটি নান্দনিক স্থাপনা। এটি দেখতে প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন আসেন। এই মসজিদের অনেক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।”
মসজিদের ভেতরে ও বাইরে মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক মানুষ নামাজ আদায় করতে পারে বলে জানান মোতাহার।
মসজিদের বাইরের দৈর্ঘ্য ১৪ দশমিক ৪৮ মিটার ও প্রস্থ ৫ দশমিক ৯৪ মিটার এবং ওপরে তিনটি গম্বুজ রয়েছে; আকৃতি আয়তাকার। পূর্বদিকের অংশে তিনটি খিলানযুক্ত দরজা রয়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় দরজাটি অপেক্ষাকৃত বড়। দরজাগুলোর বিপরীত দিকে পশ্চিম দেওয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। এক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় মিহরাবটি বাকি দুইটি মিহরাবের তুলনায় তূলনামূলক বড়।
মসজিদের চারকোণে চারটি বড় অষ্টভুজাকার মিনার রয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় বৃহৎ প্রবেশ পথের উপরে দুইটি অষ্টভুজাকার মিনার রয়েছে। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং গম্বুজের ভেতরের অংশ পাতার নকশা শোভিত। এ ছাড়া বাইরের অংশে চক্র নকশার কাজ রয়েছে।
মসজিদের সামনের দেয়ালে ফার্সি ভাষায় শিলালিপি রয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে, হায়াতে আবদুল করিম নামে এক ব্যক্তি মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হায়াতে আবদুল করিমের পরিচয় নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে দুটি মত রয়েছে।
এর একটি হচ্ছে, তিনি নাটেশ্বর নামের এক রাজার কর্মকর্তা ছিলেন। অন্যটি হচ্ছে, হায়াতে আবদুল করিম দিঘির পাড়ে মাজার থাকা সৈয়দ শাহ শরীফ বাগদাদী নামের ওই পীরের মুরিদ ছিলেন।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “বড় শরীফুর মসজিদ কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী একটি নিদর্শন। মসজিদ ও লাগোয়া দিঘিটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। দিঘির পাড়ে একজন কামেল অলির মাজার রয়েছে।
“ধারণা করা হয়, তিনি বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এই অঞ্চলে আসেন। জাতি, ধর্ম, র্বণ নির্বিশেষে উনার অনেক ভক্ত রয়েছে। এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে।“
তিনি বলেন, “আমার গবেষণা মতে, কুমিল্লায় ১৬৫৮ সালে সর্বপ্রথম শাহ সুজা মসজিদটি নির্মিত হয়। সে বিবেচনায় বড় শরীফপুর ও শাহ সুজা মসজিদ দুটি সমসাময়িক।”
“তখন মুঘল শাসনামল ছিল। যদিও এদেশে প্রায় সাতশো বছর আগে হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। তবে মুঘল শাসনামল থেকেই এ অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ ঘটে। সেই বিকাশমান সময়েই বড় শরীফপুর ও শাহসুজা মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। সে অর্থে এটি কুমিল্লার একটি প্রাচীন মসজিদ। বড় শরীফপুর মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যের অনন্য এক নিদর্শন।”
মসজিদটি দেখতে আসা শাহাদাত হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, “একদিকে নান্দনিক মসজিদ আবার পাশেই বিশাল দিঘি। এই শান্ত জলরাশির পাড়ে বসলে শরীর স্নিগ্ধ হয়ে দেহের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।”
শরীফপুর গ্রামের সমাজ সেবক জয়নাল আবেদীন কাঞ্চন বলেন, জেলা সদর থেকে মসজিদটি ৪০ কিলোমিটার ও উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ মসজিদের একদিকে ডাকাতিয়া নদী, অন্যদিকে নরহ খাল।
“অপরদিকে রয়েছে মনোহরগঞ্জ-হাসনাবাদ সড়ক। পেছনে রয়েছে বিশাল নাটেশ্বর দিঘি। এর পাড়ে মাজার শরিফ। এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে।”
আবদুল মজিদ নামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই দেখছি মসজিদটি আগের মতোই সুন্দর। কত মানুষ এখানে ঘুরতে ও নামাজ পড়তে আসেন।”
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের (কুমিল্লা কার্যালয়) আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, বড় শরীফপুর মসজিদটি কুমিল্লা জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন একটি মসজিদ। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় সংরক্ষিত।
“তিন জেলার মোহনায় মসজিদ, দিঘি ও মাজারকে ঘিরে একটি প্রত্নপর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি প্রতিটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানকে ভালোভাবে সাজিয়ে তুলতে।”