Published : 10 Jul 2025, 08:12 PM
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে গত এক দশকে সবচেয়ে বড় ধস নেমেছে এবার; যেটির পেছনে গুণগত মান ধরে রাখা, গণিতে উত্তীর্ণ হতে না পারাসহ বেশ কয়েকটি কারণ দেখছেন পরীক্ষা সংশ্লিষ্টরা।
ফলাফলের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় খারাপ ফলাফলের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলার পাসের হার কম থাকার প্রভাবও পড়েছে এ শিক্ষা বোর্ডের ফল বিপর্যয়ে।
সরকার পতনের আন্দোলনের সময় পাঠদানে ব্যাঘাতকেও শিক্ষার্থীদের পাস না করার কারণ বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
এ বছর এ বোর্ডের পাসের হার ৭২ দশমি ০৭ শতাংশ; যা ২০২৪ সালের চেয়ে ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ফলের তথ্য বলছে, শুধু চট্টগ্রাম নয়, সব শিক্ষাবোর্ডেই পাসের হার কমেছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবারের ফলাফলে গুণগত মান দেখা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যা লিখেছে, সেটির ভিত্তিতে খাতা মূল্যায়ন হয়েছে। আগের বছরগুলোতে পরীক্ষার্থীদের ‘গ্রেস নম্বর’ নিয়ে গ্রেড বাড়িয়ে দেওয়া হত। কিন্তু এবার সেটি হয়নি।”
তিনি বলেন, পরীক্ষার ফলাফল খারাপের পেছনে আর একটি কারণ হতে পারে পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটা। ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদানে ব্যাঘাত হয়েছে। সে কারণেও ফলাফলে একটা সার্বিক প্রভাব পড়তে পারে।
মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার ফলে ধস
সার্বিক ফলাফলের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হয়েছে মানবিক বিভাগে। এ বিভাগে পাসের হার ৫৫ দশমিক ০২ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
অর্থাৎ মানবিক বিভাগে গত বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ২১ শতাংশীয় পয়েন্ট কম শিক্ষার্থী পাস করেছে।
ব্যবসায় শিক্ষা শাখাতেও ফলাফল আগের বছরগুলোর তুলনায় খারাপ হয়েছে। ২০২৪ সালে এ শাখা থেকে ৮৪ দশমিক ১১ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করলেও এবার তা এ হার ৭৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
এ বছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করেছেন ৯২ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী, যা ২০২৪ সালে ছিল ৯৪ দশমিক ৫২শতাংশ।
১০ বছরের ফলা কেমন ছিল
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১০ বছরের মধ্যে সবেচেয়ে খারাপ ফলাফল হয়েছে এ বছর, ৭২ দশমিক ০৭ শতাংশ। এর আগে সর্বনিম্ন পাসের হার ছিল ২০১৮ সালে ৭৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৭৮ দশমিক ২৯, ২০২২ সালে ৮৭ দশমিক ৫৩, ২০২১ সালে ৯১ দশমিক ১২, ২০২০ সালে ৮৪ দশমিক ৭৫, ২০১৯ সালে ৭৮ দশমিক ১১, ২০১৭ সালে ৮৩ দশমিক ৯৯ এবং ২০১৬ সালে ৯০ দশমিক ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে।
বিষয়ভিত্তিক পাসের হার
শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বলছে, এ বছর সবচেয়ে কম পাস করেছে সাধারণ গণিতে। সব বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক এ বিষয়ে পাস করেছেন শতকরা ৮১ দশমিক ৫৩ জন, যা বিষয়ভিত্তিক পাসের সর্বনিম্ন হার। এরপর রয়েছে ইংরেজিতে ৮৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। উচ্চতর গণিতে পাসের হার ৯৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় পাসের হার বাংলায় ৯৮ দশমিক ৬২, সাধারণ বিজ্ঞানে ৯২ দশমিক ৭৮, রসায়নে ৯৭ দশমিক ২৯, পদার্থ বিদ্যায় ৯৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, জীব বিজ্ঞানে ৯৮ দশমিক ৭৬, হিসাব বিজ্ঞানে ৯৫ দশমিক ৫৬, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিংয়ে ৯৬ দশমিক ০২ শতাংশ, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি বিষয়ে ৯৮ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং ব্যবসায় উদ্যোগে ৯৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।
মানবিকের ফলে বিপর্যয় ও পার্বত্য অঞ্চলের খারাপ ফল
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহামদ পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর এ বোর্ডের পাসের হার কমার ক্ষেত্রে মূল কারণ হিসেবে মানবিকে কম সংখ্যক শিক্ষার্থীর উত্তীর্ণ হওয়ার কথা বলেছেন।
পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলার পাসের হার প্রতিবছর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সার্বিক ফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, “১৯৯৫ সালে শিক্ষা বোর্ডের যাত্রার পর থেকেই চট্টগ্রাম মহানগর, জেলা ও কক্সবাজারে পাসের হার ঠিক থাকলেও আমরা যখন ‘কোডিং- ডিকোডিং’ করতে যাই, তখন পাবর্ত্য জেলাগুলোর কারণে সার্বিক ফলাফল নিচে নেমে যায়।”
শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান মনে করেন, ভৌগলিক অবস্থা ও অবকাঠামোগত কারণে পার্বত্য অঞ্চলের স্কুলগুলো চট্টগ্রামের তুলনায় পিছিয়ে। এটার জন্য সরকারের সদূর প্রসারী পরিকল্পনা লাগবে। চট্টগ্রামের স্কুলের যে সুবিধাটা আছে সেটা পার্বত্য অঞ্চলের স্কুলগুলোতে নেই।
“সেখানে শিক্ষক নেই। আমি এমনও দেখেছি, হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষকরা পদার্থ বিজ্ঞান পড়ান। সেখানে অবকাঠামোসহ যত বেশি সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হবে, স্বাভাবিকভাবে ফল ভালো হবে।”
এ বছর তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙামাটি জেলায় পাসের হার ৫৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৭২ শতাংশ।
এছাড়া এ বছর খাগড়াছড়িতে পাসের হার ৬০ দশমিক ৭৭ ও বান্দরবানে ৫৩ দশমিক ১২ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল যথাক্রমে ৭২ দশমিক ২৫ ও ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
মানবিকের আগের ফল যেমন ছিল
এবার চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মানবিক বিভাগের পাসের হার ৫৫ দশমিক ০২ শতাংশ। এর আগে এত খারাপ ফলাফল ছিল ২০১৮ সালে ৬০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এ বিভাগে ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ২৩ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৬৫ দশমিক ৪১, ২০২২ সালে ৭৮ দশমিক ৮২, ২০২১ সালে ৯৭ দশমিক ৪৭, ২০১৯ সালে ৬৫ দশমিক ৭৯, ২০১৭ সালে ৭৩ দশমিক ৩৬ এবং ২০১৬ সালে ৮৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।
শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত কিছুটা দুর্বল শিক্ষার্থীরা মানবিকে ভর্তি হয়ে থাকেন। তাদের সবচেয়ে বেশি জড়তা থাকে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে। এ দুই বিষয়ে ফল খারাপের কারণেই মানবিকে ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে।